Monday, February 22, 2010

ভর -- মহাশ্বেতা মিত্র

এখন উষার পরনে একটা জলরঙা ম্রিয়মান শাড়ি। এখন গরমে উষার কপাল আর থুতনিতে ঘামের বিন্দুর শোভাযাত্রা। আর ঠিক এখনই, আজ এই মুহূর্তে এই লক-আপ সেলে, উষার এক হাত দূরে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত অনেকগুলো লোহার গরাদ।

আর তার ও-পারে, এই থানার চওড়া উঠোনেরও ও-পারে, উঠোনের শেষে এক দেয়াল রোদ্দুরেরও ও-পারে, উষা হিসেব করে দেখল, এখন নিশ্চয়ই বেলা গড়িয়ে ভরদুপুর।

তা সময়ের হিসেবে দেখতে গেলে উষা এই ছোট্ট কুঠুরিতে আটক বেশিক্ষণ নয়, সবে আজ সকাল থেকে। কিন্তু ভাবতে গেলে মনে হচ্ছে এক যুগ আগের ঘটনা। এই শহরটা মফস্‌সল টাইপের। চট করে এখানে নতুন কিছু হয় না। তাই ভোর রাতে ভীষণ জোরে দরজায় কড়া নাড়া শুনে উষা যখন আধো আলোয় দেখল দরজার ও-পারে প্যান্ট-শার্ট পরা গোটা দুই মেয়ে-পুলিশ, তখনই উষার মন কু গেয়েছিল। মেয়ে-পুলিশ দুটো ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে শুধু জানতে চাইল, তার নাম উষা প্রামাণিক কি না, আর তার স্বামীর নাম সমর প্রামাণিক কি না। উষা শুধু বলল, ‘হ্যাঁ, স্বর্গত সমরেন্দ্র নাথ প্রামাণিক।’



পেছনে পুলিশের গাড়িতে আরও কিছু ছেলে-পুলিশ ছিল, তাদের মধ্যে এক জন এ বার নেমে এসে বলল, ‘আপনি কিঙ্কর সাহুকে চেনেন?’ ওই একটা কথাতেই উষার মনে এদের আসার কারণ নিয়ে যেটুকু সেন্দহ ছিল, তা নেভা মোমবাতির ধোঁয়ার মতো উবে গেল। মনের ভেতরের একতাল বিরক্তি আর ঘেন্নাকে লুকিয়ে উষা কোনও রকমে মুখে অবাক ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার স্বামীর বন্ধু ছিলেন উনি।’ ছেলে-পুলিশ বলল, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে এক বার থানায় আসতে হবে।’ মাঝ-তিরিশের উষা সবে বলতে যাচ্ছিল, ‘আমি বিধবা মেয়েছেলে...’ কিন্তু তার আগেই মেয়ে পুলিশেরা এসে তার দু’হাত চেপে ধরল।

'কী নাম?’

উষা এ ঘরে একা নয়। গোলগাল মুখের লাল ডুরে শাড়ি পরা আরও এক জন মেয়েছেলে এ ঘরে। বয়স হয়তো উষার মতো। উষা খেয়াল করেছে গোলগাল মুখ এইটুকু ঘরের এক কোণে বেশ সাজিয়ে বসেছে। ঘরের এক ধারে ছোট কার্ড বোর্ডের বাক্সের ওপর চিরুনি, চুলের ফিতে, সিঁদুর কৌটো সাজানো। একখানা মাদুরের ওপর পরিপাটি করে বিছানো লাল ফেরনি। সেখান থেকে হাসিহাসি মুখে এখন সে উষার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে।

দেখে উষার গা-পিত্তি জ্বলে গেল। তাকে কি এ বার চোর-ছ্যাঁচোরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে নাকি!

লাল ফেরিনকে হাত দিয়ে টানটান করে দিয়ে গোলগাল মুখ আবার বলল, ‘আমার ননদের নিজের হাতে বানানো। ওদের এই সবেরই ব্যবসা। মেশিন আছে।’ তার পর প্রায় এক নিশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছিল?’

উষা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খুন’। আর ওই একটু শব্দেই উষার প্রত্যাশিত ভাবে গোলগাল মুখ চুপ করে গেল।

উষাকে কেন ধরে আনা হয়েছে, পুলিশেরা সে বিষেয় এখনও একটা কথাও বলেনি। কিন্তু উষা জানে। তাকে পুলিশেরা ধরে এনেছে তার স্বামীকে খুন করার জন্যে। আর সে কথা ভাবতেই কিঙ্করের ওপর রাগে উষার মাথাটা দপ করে উঠল। এইটুকু যদি কলজের জোর, তবে এত নাগর সাজার শখ কেন রে বাপু? একটু না হয় ওম দিয়ে কথা বলত, তাই বলে কি উষা তোকে হাত-পায়ে ধরতে গেছিল? তখন কিঙ্করের সে কী ঝিকুটি!

‘উষা তুমিই আমার সব’, ‘উষা, তোমায় না দেখে আমার একটা দিনও চলে না’ থেকে শেষের দিকে ‘উষা, তোমায় না পেলে কোন দিন কিছু একটা করে বসব’। উষা শুনে মনে মনে হাসত। মাথার মধ্যে কতকগুলো রঙিন স্ফুলিঙ্গ আঁকড় কেটে বলে যেত, ‘কাজ হচ্ছে, কাজ হচ্ছে।’

এ সবই অবশ্য অনেক আগের ঘটনা। এই থানার সামনের ঘরে যখন উষাকে পুলিশরা হাতে ঠাণ্ডা হতাকড়া পরিয়ে কাঠের বেঞ্চিতে বসিয়ে রাখল, তারও আগের। পুলিশের গাড়িতে আসতে আসতে যখন নতুন সূর্যটা ধলাগড়ের কারখানার দুই চিমনির মাঝের আকাশটাকে কমলা আর গোলাপির জলরঙে মাখামাখি করে দিল, তারও আগের।

উষার বরটা ছিল বোকা-সোকা। আর পাঁচটা রঙের মিস্ত্রি যেমন ধসাপচা হয়, সে রকমই। কোনও দিন কিছু আঁচ পায়নি। বরঞ্চ সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকত উষা বুঝি ধরে ফেলল কবে সে চোলাই খেয়ে ফিরছে। বুঝতে পারেনি খোলা জানলা দিয়ে ঘরে তখন নীল বেড়ালের আনাগোনা। নাঃ, উষা ভেবে দেখেছে, ওই রকম লোককে দিয়ে কিস্যু হত না।

উষার ছোটবেলায় ওর বাবা ওকে একটা কথা বলত খুব— ‘কড়েয়া মোলো, বেবাক মোলো, পোইতি মোলোক না,/গেঁহু মোলো, সোহর মোলো, জ্ঞান মোলোক না।’

অথার্ৎ, টাকা পয়সা, কথাবার্তা, সম্পত্তি, আত্মীয় বন্ধু— সবেরই শেষ আছে, শেষ নেই শুধু সম্মান আর জ্ঞানের।

উষার বরটার কিছুই ছিল না। না টাকা-পয়সা, না জ্ঞান।

গত বছর এক শীতের দুপুরে উষার বাড়ির চাতালের বেল গাছটার গোড়ায় যখন তার পাতাগুলো ছায়ার ফাঁদ ফেলতে ব্যস্ত, বাড়ির ভেতরে কিঙ্কর জানলা বন্ধ অন্ধকারের প্রলেপ মাখিয়ে উষাকে বলল, ‘উষা, তোমায় না পেলে কোন দিন কিছু একটা করে বসব।’

এ রকম একটা দিনের জন্য উষা বহু দিন ভেবে রেখেছে। কিন্তু ততক্ষণাৎ মুখে কিছুই বলল না। খানিকক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তা এতই যদি পেতে চান, তবে কিছু একটা করলেই পারেন। আপনার বন্ধু বেঁচে থাকতে...।’

ব্যস, কে ভেবেছিল এই ঘটনার চার দিনের মাথায় ধলাগড় খালের ধারে একগাদা কচুরিপানা আর মাদার ডেয়ারির ছেঁড়া প্যাকেটের মাঝে উষার বরের মাছি ভনভনে লাশটা পাওয়া যাবে? আর কে-ই বা ভেবেছিল, ঠিক সেই দিন থেকে কিঙ্কর সাহু বেপাত্তা হবে ?

‘হতচ্ছাড়া রাজুটা যে কখন আসবে?’, বসে থেকে থেকে গোলমুখ আবার আলাপ করার ফিকির চালায়। উষা ফিরে তাকাতে লাল ফেরিন থেকে হাসি মুখে বলে, ‘রাজু এখানে সবাইকে খাবার এনে দেয়। সেই কখন সকালবেলা চা-বিস্কুট দিল, ভাত আনার নাম নেই।’ তার পর বলল, ‘আমার নাম রমা। এখানে সবাইকে চিনি আমি, সাত মাস হল তো। কবে কোর্টে কেস দেবে কে জানে!’

এই লক-আপ সেলটা মোট চারটে সারি বাঁধা সেলের একটা। বাকি সেলগুলোর কোনও কোনওটাতে লোক আছে। সেলগুলোর ঠিক সামনেটায় খোলা আকাশের নিচে ছোট ইট বাঁধানো উঠোন। উঠোনের অপর প্রান্তে দুটো টিনের দরজাওলা বাথরুম গায়ে গায়ে। সেই দরজাদের গায়ে ট্যারাব্যাঁকা সবুজ অক্ষরে লেখা ‘পুং’ আর ‘লেডিজ’। আর তার পেছনে উঁচু দেয়াল। যে-দেয়ালের ও-পারে রয়েছে ধলাগড়ের খাল, কিঙ্কর সাহু আর উষার চাতালের বেলগাছ।

‘আমার বাড়ি হচ্ছে চুর্ণীপুর। বাসন্তী থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা বাসে। ডালিমতলার বনবিবির যে ভর হয়, সে আমার বাড়ি থেকে বলতে গেলে হাঁটাপথ। ডালিমতলার নাম শুনেছ তো? ওখানে জায়গা নেই বলে এই এত দূরে পাঠিয়ে দিল। বোঝো ব্যাপার! তুমি কি লোকাল নাকি?’ গোলমুখের রমা এমন ভাবে বকবক করতে থাকে, যেন তার চাকরির বদলি হয়েছে।

উষার মনে পড়ল সে বিয়ের আগে এক বার ভর দেখেছিল। পাড়ার কানাইদার সঙ্গে। তখন উষা সবে শাড়ি ধরেছে। সুবোধের মুদির দোকানে দাঁড়িয়ে এ কথা সে কথার পরে উষা কানাইদাকে নিচু গলায় বলেছিল, ‘কেউ তো নিয়ে যাওয়ার নেই, নইলে যেতাম।’ শুনে বিড়িখোর কানাইদার সে কী লাজুক হাসি! আর সে হাসি উষার মনে সর্ষেখেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার হলুদ-সবুজ ঢেউ তুলে দিয়ে গেল— ‘কাজ হচ্ছে, কাজ হচ্ছে’।

কানাইদা নিজের বউকে লুকিয়ে উষাকে নিয়ে গিয়েছিল জানগুরুর থানের মেলায়। জানগুরুর বিবির তখন ভর হয়েছে। ছোট্টখাট্ট চেহারার জানগুরুর বিবিকে উষা তার আগে বারকয়েক দেখেছে— কখনও শুকনো গাছের ডাল কুড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে যেতে, কখনও বা গরুদের পাল দিতে। সেই বিবিই তখন একটা উঁচু মঞ্চে বসে মাথার লম্বা চুল সামনে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে খুব উঁচু আওয়াজ ‘নাকি নাকি’ সুরে কী বলছিল। কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না। চতুর্দিক লোকে লোকারণ্য। বিবির দু’পাশে আধ ডজন জ্বলন্ত ধুনুচি। তাদের ধুনোর ধোঁয়ায় বাকি কিছু তেমন দেখা যায় না। একটা লোক মাঝে মাঝে বিবির কানের কাছে এসে কিছু বলছিল আর বিবি নাকি সুরে চেঁচিয়ে তার জবাব দিচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল এ হল যারা বিবিকে পুজো পাঠিয়েছে, তাদের প্রশ্নের উত্তর। আর প্রতিটা উত্তরের পরেই কান ফাটানো আওয়াজ বেজে উঠছিল ঢাক আর কাঁসর।

মেলা থেকে ফেরার পথে সর্ষেখেতের ভেতর শুয়ে কানাইদা বলেছিল, ‘ভর না ভড়ং! কোশ্চেন পিছু পাঁচ টাকা। সারা বছরের ইনকাম উঠে আসে এই ক’টা দিন থেকে।’

উপুড় হয়ে শোয়া উষার মুখে তখন গরম জিলিপির রস আর খোলা পিঠে কানাইদার থাবার চোর-চোর খেলা।

শুধু কানাইদা নয়, মুদির দোকানের সুবোধ, ব্রজমোহিনী হাইস্কুলের সত্যেন মাস্টার, ফুটবল-পাগল রাজেশ উষার সঙ্গে প্রথম আলাপের পরই বানের চোরা জল পৌঁছে যায় সবার কাছে। সবাই ওর সঙ্গে একা একা গল্পগুজব করতে চায়, কেউ কেউ সেন্ধর পর স্কুলবাড়ির পেছনের অন্ধকার মাঠে তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে। উষা কখনও ‘হ্যাঁ’ বলে, কখনও পাত্তা দেয় না। যৌবনের সেই উষসী লগ্নেই উষা বুঝে গেল কী ভাবে জিততে হয় পুরুষ মানুষের পার ভাঙার খেলা।

সমরের সঙ্গে উষার যখন সম্বন্ধ আসে, কেউ গিয়ে সমরের মাকে ভাংচি দিয়ে এল। সে প্রায় বিয়ে ভাঙার উপক্রম। সমরদের বাড়ি থেকে বলে পাঠায়, ‘না বাপু, শুনছি মেয়ের স্বভাব-চরিত্র ভাল নয়।’ সমরের তখনও কারখানার পুরনো কাজটা যায়নি, বেশি দাবিদাওয়াও নেই। উষার বুড়ো বাপ মেয়েকে এই মারে তো সেই মারে। উষা ব্যাপারটা দু’এক দিন দেখে এক দিন সন্ধেবেলা সমরের কারখানার গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সমর যখন কারখানা থেকে বেরোল তখন উষা নরম গলায় ডাক দিল, ‘শুনছেন?’ সমর প্রথমে অন্ধকারে চিনতেও পারেনি। যখন চিনতে পারল, তখন খুবই অবাক হল। উষা মিষ্টি হেসে বলল, ‘ভয় নেই, আমি খেয়ে ফেলব না। আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’

এর ঘণ্টা দুয়েক পরে উষা যখন পা টিপে টিপে কালো সায়রের ধারের নির্জন শেতলা মন্দির থেকে নিজের বাড়ি ফিরে এল, তখন কে-ই বা আর জানল। তার পরদিনই সমরের বাড়ি থেকে খবর এল, ছেলে বেঁকে বসেছে, এ মেয়ে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।

জানগুরুর মেলার জিলিপির কথা মনে হতেই বোধহয় হঠাৎ উষার কষা ত্রিফলার স্বাদের ঢেকুর উঠে আসে। পিত্তির ঢেকুর। কাল রাতের পর কিছু খাওয়া হয়নি। রাজু কেন, সামনের চত্বরটাতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। মফস্‌সলের থানা বলে বোধহয় সবাই দুপুরবেলা বাড়িতে খেতে গেছে।

বেলা বাড়তে একটু জোরে বাতাস উঠেছে। টুকরো টুকরো মেঘগুলো সূর্যকে ঘেরাও করার ফন্দি করছে। আর তাদের আন্দোলনের বার্তা নিয়ে তাদের ছায়ারা মহাকাশযানের দ্রুততায় মাঠ ঘাট পেরিয়ে এই ইট বাঁধানো উঠোনটাকে জানিয়ে যাচ্ছে ‘তৈরি থেকো’। দূরের উঁচু দেওয়ালের গায়ে একটা কাগজফুলের লতানে গাছ। নিজের ক্ষীণ ডালপালা আর পাতার সেনাবাহিনী নিয়ে ধাওয়া করে পৌঁছে গেছে দেওয়ালের উপর প্রান্তে। গোলাপি ফুলের ছোট্ট ছোট্ট অলঙ্কার বিছানো গায়ে। জোরালো হাওয়ায় সেই অলঙ্কারদের কিছুকে খুইয়ে এখন সে নির্লজ্জের মতো ডালপালা দিয়ে মাটি আঁকড়ানোর খেলায় ব্যস্ত।

ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু আগের হাঁসফাঁস ভাবটা অনেকটা কেটে গেল। দুটো সেলের পর থেকে কোনও পুরুষকণ্ঠ গান ধরল: ‘আমি যদি ভুল করি মা...।’ সেই গানের সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার টানে উষার মাথার ওপরে তার দিয়ে ঝোলানো ইলেকট্রিক বাল্বটা দুলতে থাকে।

রমা গানের দিকে চোখের ইশারা করে বলে, ‘অজয় মাস্টার, এখানের সবার দাদার মতো। নকশাল করে বলে সরকার থেকে আটকে রেখেছে।’

রমা লাল ফেরনিতে বসে বলে চলে, ‘মেয়েমানুষ, এই থানার ঘেরাটোপে থাকা কি চাড্ডিখানি কথা! কত আসান-বিষেনের লোক আসে! এই সাতটা মাস কী ভাবে যে কাটালাম! আপিসাররাও কি কম সোঁরেল? বাবু বাবু দেখতে, কিন্তু মনে কু-মতলব।’ উষা মনে মনে ভাবে, ‘তোমার মতো শরীরের মেয়ের আবার কী ভয়!’ কিন্তু মুখে কোনও উত্তর দেয় না।

বিয়ের পরে পরের একটা ঘটনা মনে পড়ে উষার। এক গরম কালের রাত। সে-দিন দমপচা গরম। উষা সব জানলা খুলে দিল। সে-দিন বোধহয় পূর্ণিমার রাত ছিল। কোথাও এক ফোঁটা হাওয়া নেই। বাইরে চাঁদভাসী মাঠ আর স্তব্ধ গাছের সারিরা একমনে ঘরের ভেতরে ওদের আদিম ব্রীঢ়াভঙ্গন দেখতে থাকে। এক সময় সমর ঘামে ভেজা সর্পিল শরীর নিয়ে ছিটকে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘তোর বড় খিদে রে, বউ!’ উষা ভাবে পুরুষ মানুষের এই এক ঠেলা, যতক্ষণ পাচ্ছে না, ততক্ষণ হামলায়; তার পরে দম শেষ।

রমা আপন মনে বকবক করে চলে। নকশালবাদী অজয় মাস্টারের রামপ্রসাদী ভেসে আসতে থাকে।

হঠাৎই থানার অফিসের দিকের দরজা খুলে গেল। এক জন সুপুরুষ পুলিশ সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে সেলগুলোর দিকে এগিয়ে এল। বয়স তিরিশের বেশি নয়। ইস্ত্রি করা ইউনিফর্ম, চোখে সানগ্লাস, দেখে বোঝা যায় এ পদমর্যাদায় আর্ম-পুলিশের মতো নয়। রমা ফিসফিস করে বলল, ‘ইন্সপেক্টর স্যর। সদর থেকে ভিজিটে এয়েছেন।’ ইন্সপেক্টরের পাশে এই থানার এক শাগরেদ। ইন্সপেক্টর তাকে প্রশ্ন করেন, ‘সেলে লাঞ্চের মিল দেওয়া হয়েছে?’

শাগরেদ কিছু বলার আগে উষা বলে উঠল, ‘না।’ ইন্সপেক্টর এগিয়ে এসে চোখ থেকে চশমা খুলে উষার দিকে তাকান। উষার স্পর্ধা দেখে অবাক আশঙ্কিত রমা বুঝে পায় না কী করা উচিত। ইন্সপেক্টরের চোখের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে চেষ্টা করে আসন্ন বিপদ আর কত দূরে।

আর সেই চোখের অনেক পলেস্তরা গভীরে উষা মুহূর্তে দেখে নেয় রূপসী ঊর্ণীনাভের জালে আটক এক পতঙ্গকে। উষা গলা নামিয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘আমাদের কথা কে-ই বা ভাবছে স্যর, আমরা নিজেরাই কি ভেবেছি?’

দমকা বাতাস আবারও উঠোনের শুকনো পাতাদের এলোমেলো করে দেয়। তারপর পাঁচিল পেরিয়ে উড়ে যায় বাইরে। হয়তো ধলাগড়ের খাল বা উষার চাতালের বেল গাছটার দিকে।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
-----
সংগ্রহ: আনন্দবাজার ডেইলি: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০

No comments: