Sunday, January 31, 2010

জট - সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

আমি স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করি। এর জন্য নামমাত্র অনুশোচনা বা অপরাধ বোধ আমার নেই। না, কোনও দূরারোগ্য চিরস্থায়ী ব্যাধি আরতির, মানে আমার বউয়ের নেই। একঢাল কালো চুলের আরতি আজও স্নিগ্ধ-সুন্দরী। একটু হিমোগ্লোবিনের খামতি ছাড়া সে আমার চেয়ে অনেক সুস্থ। আমায় নিয়মিত প্রেশার এবং ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। তাই আমার কামনা সব সময়ই মাথা হেঁট করে থাকে ওর সুস্থতার সামনে। এখন কথা হচ্ছে, আমি কেন চাইছি আরতি মরে যাক? বিয়ের আগের দু’বছর এব পরের পাঁচ বছর আরতিকে আমি কাচের পাত্রের মতো সম্ভ্রম করতাম। উৎসব-অনুষ্ঠানে নিেয় গেলে মনে হত পাত্রটা বুঝি অন্যের হাতে দিেয়ছি। আলতো একটা নজর রাখতামই। ক্রমশ এই পাহারাদারি আলগা পেড় গেল। কারণটা আরতি নিজে। আমার বন্ধু এবং তাদের বউেয়রা আমাকে বহু বার বলেছে, একটা বউ বটে তোর বা আপনার! যে প্রসঙ্গেই কথা হোক, তোকে বা আপনাকে এক বার টেনে আনবেই।



আরতির এই পতিব্রতা স্বভাব মা-ও খুব পছন্দ করত। আরতিকে বলত, এখন নিজের মরে যাওয়া নিেয় আর চিন্তা হয় না, আমার ছেলেকে যেত্নই রাখতে পারবে তুমি।


ম-বাবার আমি একমাত্র সন্তান। বাবা মারা গেছেন আমার তখন মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ার। মা গেল বছর চারেক হল। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করি। পৈতOক বািড়তে আমি, আরতি, দশ বছরের ছেলে জয়মাল্যকে নিেয় আমাদের ছায়া ঘেরা পুকুরের মতো শান্ত সংসার। এ রকম একটা সুিস্থর অবস্থায় থেকেও আমি কেন বউেয়র মৃত্যু কামনা করছি? প্রশ্নটা অনেকের কপালে ভাঁজ ফেলতে পারে। তাদের বলি, আমার ধারণা দাম্পত্যের বয়স বারো-চোেদ্দা বছর হেয় গেলে প্রত্যেক দম্পতি কখনওসখনও একে অপরের মৃত্যু কামনা করে। অবশ্যই, আর্থিক ভাবে গাড্ডায় গিেয় না পড়লে তবেই।


আমার আন্দাজ আরতিও আমার মৃত্যু কামনা করে। আর্থিক অনটনে পড়বে না, জেয়ন্ট অ্যাকাউন্ট, আমার প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, ইনশিেয়ারেন্স মিলিেয় ভালই পাবে। এক দিন ঠাট্টার ছলে আরতিকে বলেছিলাম, বুঝলে, হিসেব করে যা দেখছি, হঠাৎ করে মরে গেলে তুমি কিন্তু এখনকার থেকে সংসার চালানোর টাকা বেশিই পাবে।







এ টা শোনা র পর যে কোনও দজ্জাল বউ বলত। এ কথা বলার আগে থান কাপড় নিেয়ই ঘরে ঢুকতে পারতে। আর একটু নরম বউ হলে বলত, তুমি কী মনে করো, টাকার জন্যই তোমার কাছে পেড় আছি! এতটা নীচ ভাবতে পারলে আমাকে! আরতি এই সব মন্তব্যের ধারপাশ মাড়াল না। কথাবার্তা স্বাভাবিক চালিেয় গেল। রাতে খেলো না। পরের দিন সকালেও না খেতে দেখে, আমার ইয়ার্কির জন্য গভীর ভাবে দুঃখ প্রকাশ করি। ক্ষমাও চাই। আরতি উপবাস ভাঙে।


আরতির এহেন আচরণে আমি যে খুব কনভিন্সড, তা মোটেই নয়। আমার মৃত্যুর প্রত্যাশা ও করেই, আমি ওর জন্য যতটা করি, তার চেেয় হয়তো কম। বারো-চোেদ্দা বছর গােয়-পিঠে একটা মানুষকে সহ্য করা খুবই কঠিন কাজ। আমার হাই তোলা থেকে শুরু করে ক্ষণে ক্ষণে চশমা হারিেয় ফেলা... সমস্তটাই ওর কাছে ভীষণ ক্লিশে। আমার কাছে ওর অভ্যেসগুলোও তাই। আমাদের সম্পর্ক এখন আউট হেয় যাওয়া কোেয়েশ্চন পেপারের মতো। যৌনতার ভূমিকাও ক্রমশ অপ্রেয়াজনীয় হেয় উঠেছে। অনেকে বলতে পারেন, আমি নিজের অবদমিত নোংরা বাসনাটা আরতির মনে চাপিেয় দিচ্ছি। ও কখনওই আমার মৃত্যু কামনা করে না। হতে পারে, অস্বীকার করছি না। সত্যিই আমি তো আর আরতির মনের ভিতর বসে নেই। তবে খেয়াল রাখবেন, আমি যে ইচ্ছার কথা বলছি, তা নিতান্তই অফলদায়ী। আমি ভাবলাম আর আমার বউ মরে গেল, তা তো হওয়ার নয়। ভাবনাটা কেউ দেখতেও পাচ্ছে না। সমাজ পরিবারের নিিন্দত হওয়ার সুযোগ নেই। আমি খুশিমতো এই ভাবনা ভাবতেই পারি। যেমন, আরতি মরে গেলে আমি তোর্সাকে বিেয় করব। দরজা, জানলায় নতুন পর্দা লাগাবে তোর্সা। আমার অফিস বেরোনর সময় অনভ্যস্ত হাতে জিনিসপত্তর এগিেয় দেবে। চোখেমুখে নার্ভাস ভাব। ক্লাস ফোর-এর জয়মাল্য ওর সৎমাকে মেনে নেবে না। হেস্টলে পাঠাতে হবে ওকে। বড় হলে বুঝবে, তেতািল্লশে বিপত্নীক হেয় যাওয়া মানুষের পুনরায় বিবাহ করা খুবই স্বাভাবিক। জয়মাল্যর সঙ্গে বোঝাপড়া হেয় যাবে তোর্সার। ফের আমার সংসার সুখের হবে। এই বাসনাও নিষ্ফল! বাই চান্স আরতি যদি মরেও যায়, আমার মনে হয় না তোর্সা আমাকে বিেয় করবে। আজও তোর্সাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। তোর্সা আমার েপ্রমিকা। এখন তোর্সাদের বািড়তেই যাচ্ছি। দু’বছরে এই প্রথম বার। আজ হয়তো তোর্সাকে কিছুটা বোঝা যাবে। তোর্সা থাকে বেহালা, আমি মানিকতলা। ট্যািক্সতে চলেছি, রবিবারের বিকেল। আরতি জানে আড্ডা মারতে যাচ্ছি সল্ট লেকে সুবিমলের বািড়তে। সুবিমল আমার খুব কাছের বন্ধু। ওর অফিসেই দু’বছর আগে তোর্সার সঙ্গে আমার আলাপ। সুবিমল ছোটখাটো কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির মালিক। ওর রিসেপশনিস্ট তোর্সা। মেেয়টিকে প্রথম দিন দেখেই ভাল লেগেছিল। আগের মেেয়টা যথেষ্ট স্মার্ট, সুন্দরী হওয়া সেত্ত্বও কখনও চোখ টানেনি। আমি একটি মেেয়র রূপ ও ভঙ্গির মধ্যে যা যা খুঁজি অনেকগুলোই তোর্সার মধ্যে আছে। কথা বলছিল কাউন্টারে দাঁড়ানো এক জনের সঙ্গে। না তাকিেয়ই মেেয়দের প্রকOতিদত্ত ক্ষমতা দিেয় টের পেেয়ছিল আমার থমকে যাওয়াটা মুগ্ধতার। বাইরে সেটা বুঝতে না দিেয় শীতল অফিস সৌজন্যে বলেছিল, হোয়াট ক্যান আই...







উত্তর দিতে অশিষ্ট সময় নিেয়ছিলাম আমি। সে-দিনই সুবিমলকে আমার ভাল লাগার কথাটা বলিনি। ‘খুব পছন্দ’ ব্যাপারটা মানুষ বেশ কিছু দিন নিজের কাছে রাখতে চায়। তার পর থেকে সুবিমলের অফিসে ঘনঘন যেতাম। এই যাওয়াটাকে সুবিমল সেন্দহের চোখে দেখেনি। কারণ, মহিলা-প্রীতি নিেয় আমার কোনও দুর্নাম নেই। সেই ক’দিনে আমার মোহ-ঘোর অবস্থাকে ‘লাজুক অথচ ন্যাকা নয়’ টাইপের হাসি দিেয় স্বাগত জানায় তোর্সা। আলাপ হয়। সুবিমলের অগোচরে আমরা কেয়ক দিন আউটিং-এও যাই। তোর্সার কাছে আমি কিছুই লুকাইনি। লুকানোর সুযোগ কম। সুদর্শন, ভদ্রস্থ রোজগেরে তেতািল্লশের আমি বিেয় করিনি বললে, বিশ্বাসযোগ্য হবে না। তা ছাড়া এ ধরনের মিথ্যে বলে সম্পর্ক ক’দিনই বা বজায় রাখতে পারব। আরতি, জয়মাল্যর কথা সব বলেছি। তোর্সা বিেয় করেনি। কেন করেনি? জিেজ্ঞস করতে বলেছিল, করব। এর পর আর প্রশ্ন চলে না। অদৃশ্য বেড়া চলে আসে সম্পর্কের মাঝে। পরের বউ হবে, যতটা সম্ভব নিষ্কলুষ রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। তবু ধন্দ থেকে যায়। বিেয়র বাজারে রীতিমতো সুন্দরী মেেয়টি তিরিশ পেরিেয়ও কেন বিেয় করল না? পরের আউটিংগুলোয় প্রশ্নটা ঘুরিেয়-ফিরিেয় তুলেছি। নানা রকম উত্তর দিেয়ছে, বিেয় করে কী হয়? এখন যেমন আছি, তার চেেয় যদি খারাপ থাকি। বিেয় করার মতো একটা ছেলে পেলাম না। পেলে দেখা যাবে।


আমার মধ্যে কী পেলে যে, সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারছ? জিেজ্ঞস করেছিলাম। ফাজলামির হাসি হেসে তোর্সা বলেছিল, প্রথম দিন দেখেই মনে হেয়ছিল আপনার সঙ্গে আমার জমবে। ঠাট্টার আড়ালে থাকা অনুরাগটা ধরতে অসুবিধে হয়নি আমার। তোর্সা বলতে চেেয়ছিল, আপনি আমার প্রতীক্ষার অবসান। আরও কেয়কটা কমিপ্লমেন্ট তোর্সা আমাকে দেয়। আপনি বেশ অকপট। ফ্ল্যাটারি যে করছেন, সেটাও বুঝিেয় দেন। আমার মন পেতে চেেয় অযথা বউদির নামে নিেন্দমন্দ করেন না। বেশির ভাগ অবৈধ েপ্রমের এটাই হাতিয়ার।


তোর্সাকে বলেছিলাম, েপ্রম কখনও অবৈধ হয় না।


আমাকে আপনার হঠাৎ এত পছন্দ হেয় গেল কেন? জানতে চেেয়ছিল তোর্সা।


বলেিছলাম, জানি না।


এত কথার পরে যেখানকার প্রশ্ন, সেখানেই রেয় গিেয়ছিল, ওর বিেয় না করার কারণটা জানা যায়নি।


সুবিমল স্কুলবেলার বন্ধু। ওকে তোর্সার কথা বলেই ফেললাম। মিনিটখানেক অবাক হেয় বসেছিল। বলল, আমি কিছুই টের পেলাম না! কত দূর এগিেয়ছিস তোরা?


বললাম, বেশি দূর নয়। রাত কাটাইনি কোথাও। ওই ধরনের অ্যােপ্রাচ করার সিচুেয়শন তৈরি হয়নি। ট্যািক্সতে বসলে হাতটাত ধরি। সিনেমা, থিেয়টার দেখতে গিেয় অন্ধকারের সুযোগ নিেয় শব্দভেদী বাণের আন্দাজে আচমকা চুমু খাই, প্রায়শই তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।


ওর দিক থেকে রেসপন্স কেমন? জানতে চেেয়ছিল সুবিমল।


বলেছিলাম, মজা পায়। বাধা দেয় না। আগ বািড়েয় কিছু করে না। এমনকী ফোনও নয়। যোগাযোগ ব্যাপারটা আমি একতরফা রক্ষা করি। দেখি ও ফোন করে কি না, পরীক্ষা করতে গিেয় এক বার কুিড় দিন পার করেছি। ফোন সেই আমাকেই করতে হল, নয়তো সম্পর্কটা থাকতই না।


টাকাপয়সা খসায় কেমন, যখন বেরোসটেরোস?


খরচ আমিই করি। ও খেয়াল রাখে, সেটা যাতে বেশি না হেয় যায়। বেচারি নিজে কিছু খরচ করে উঠতে পারে না। স্যালারি যা দিস, তাতে সম্ভবও নয়।


আমার খোঁচাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গম্ভীর মুখে বসে রইল সুবিমল। কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল, মেেয়টা কি তোকে বিেয় করতে চায়? তার আগে সব কিছু দিেয় ফেলতে চাইছে না?







বললাম, বরং উেল্টা। আমি ওকে বিেয় করতে চাই বলেছি। সংসার ছেেড় বেরিেয় আসব। বউ-ছেলের খাওয়া-পরার সংস্থান থাকবে। তোর্সা এ সব কথা উিড়েয় দিেয়ছে। আমিও যে খুব একটা মানসিক প্রস্তুতি নিেয় েপ্রাপোজালটা দিেয়ছিলাম, তা নয়। ওকে টেস্ট করার জন্যই বলা। তোর্সার বক্তব্য, কারও সংসার ভাঙতে আমি চাই না। এ সব বলার আগে আপনার নিজের ছেলের কথা ভাবা উচিত ছিল। ওর বয়সের সন্তান তার বাবাকে দুনিয়ার সব চেেয় ভাল লোক বলে মনে করে। আমি বলেছিলাম, তা হলে আমাদের এই রিলেশনের মানে কী, পরিণতিই বা কী হতে যাচ্ছে? আমি তো তোমাকে সারাক্ষণের জন্য পেতে চাই। ভেবেছিলাম তোর্সা বলবে, এই সম্পর্কটা সুন্দর বন্ধুেত্বর। শাক দিেয় মাছ ঢাকার মতো দরকার পড়লেই েপ্রমিক-েপ্রমিকারা বন্ধু শব্দটাকে ব্যবহার করে। তোর্সা কিন্তু করল না। বলল, এটাকেই েপ্রম বলে। েপ্রমের পরিণতি সব সময় মিলন নয়। ...আমার কথা শেষ হতেই সুবিমল বলে উঠেছিল, অল বোগাস। মেেয়টা নির্ঘাৎ লেসবিয়ান, মাঝখান থেকে তোকে একটু নাচাচ্ছে। ছেলে নাচানো ওর কাছে অবসর বিনোদন।


সুবিমলের Ðসঙ্গে সহমত হতে পারলাম না। বললাম, আমি চার-ছ’ঘণ্টা হামেশাই ওর সঙ্গে কাটিেয়ছি। বািড় থেকে ছাড়া ওর মোবাইলে অন্য কোনও ফোন আসেনি। সমকামী পার্টনার বা কোনও নৃত্যরত ছেলে থাকলে নিশ্চয়ই এক বার হলেও ফোন করত।


তা হলে অবশ্যই ওর কোনও অসুখ আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। বিেয়র পক্ষে যা প্রধান অন্তরায়। তোর সঙ্গে গভীরতম সম্পর্কে মেেয়টা কোনও দিনই জড়াবে না। খামোখা অশািন্ততে মরবি। রিলেশনটা থেকে বেরিেয় আয়।


সুবিমলের উপদেশ শোনার পর বললাম, আমি বোধ হয় আর বেরোতে পারব না রে। সত্যিই ওর েপ্রমে পেড় গেছি। বহু দিন আগে যেমন হত, তাকে একটুখানি দেখা, খানিকক্ষণ কাছাকাছি থাকতে পেরেই যেমন ধন্য হেয় যেতাম। তোর্সার বেলাতেও তাই হয়। এক ধরনের তেষ্টা। সেটাও মোটেই তেমন শরীরকেিন্দ্রক নয়।


সুবিমল বলল, ও সব কিছুই না, পঁয়তািল্লশ ছুঁেয় যাওয়া পুরুষদের ও রকম একটু হয়। পড়ন্ত যৌবনের সিনেড্রাম। সংসারে মন দে; বউ-ছেলের সঙ্গে সময় কাটা। দেখবি, ঠিক বেরিেয় আসতে পারছিস।


সুবিমলের পরামর্শ ম্যাগাজিনের ‘কানে কানে’ বিভাগের মতো শোনাল। মোটেই গ্রহণ করলাম না। উেল্ট রোখ চেপে গেল। অসুখ গোপন করে আমাকে নিেয় এ ভাবে পুতুল খেলার কোনও মানে হয়! ঠকে যাওয়া মানুষ মনে হতে লাগল নিজেকে। আরতির বদলে তোর্সাকে নিেয় ঘর করার বাসনাটা ইদানীং চরম বিদ্রুপের মতো ঠেকে। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হেয় যাই। তাই দেখে আরতি কপট সেন্দহে যখন জিেজ্ঞস করে, কী ব্যাপার, এত কী ভাবছ? কার কথা?


আরতির মিচকি হাসির পিছনে পরিহাসই দেখতে পাই। যেন বলছে, যতই ছটফট করো, আমি ছাড়া তোমার গতি নেই।







ভিতর ভিতর ভীষণ অিস্থর হেয় পিড়। তোর্সার সঙ্গে রিলেশনের একটা হেস্তনেস্ত চাই। আমি পড়ন্ত যৌবনের ভিখারি নই, যতটুকু দেবে, তাতেই কOতার্থ হেয় যাব। একই সঙ্গে এটাও জানি, তোর্সা যদি হঠাৎ রাজি হেয় যায় আমাকে বিেয় করতে, সংসার ছেেড় সহজে বেরোতে পারব না। আমার কল্পনাবিলাস মতো আরতি যদি মরে যায়, কতটা শোকপ্রাপ্ত হব, তারও কোনও নির্দিষ্ট ধারণা আমার নেই। এমনও হতে পারে, আরতির সঙ্গে কাটানো সকল মুহূর্ত পাথরের ওজন নিেয় নেমে আসতে পারে বুকে। এ সব সেত্ত্বও আমাকে নিেয় তোর্সার এই খেলাটা মেনে নেওয়া যায় না। কিছু দিন ধরেই ওকে তাই বলতে শুরু করেছিলাম, আমাদের এই সম্পর্কের কোথাও কোনও স্বীকOতি নেই। কেমন যেন বেওয়ারিশ। কোনও বন্ধুকে জোর দিেয় বলতে পারি না, তোমার সঙ্গে েপ্রম আছে। বন্ধু যদি ভেরিফাই করতে যায় তোমার কাছে, সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করবে। অদ্ভুত একটা লক্ষণরেখা টেনে রেখেছে। তোমার জগতে আমাকে প্রবেশ করতে দাও না, আমার জগতেও আসতে চাও না। আমাদের েপ্রম যেন আলো-বাতাসের আড়ালে রেয় গিেয়ছে। বন্ধু পরিচয় দিেয় এক দিন আসতে পারো তো আমার বািড়। তোমার িপ্রয় মানুষটি কোথায় শোয়, বসে। জানলাটা পিশ্চমে না দক্ষিণে...


কথা কেেড় তোর্সা বলেছিল, আমি বউদিকে ফেস করতে চাই না। আপনার ছেলেকেও না। নিজেকে বড় অপরাধী লাগবে। আপনি বরং আমাদের বািড়তে আসুন। আপনার েপ্রমিকা কোথায় দাঁিড়েয় আনমনে আপনার কথা ভাবে...


েসই সূত্রে আজ তোর্সার বািড় যাওয়া। বেহালা চৌরাস্তা এসে গেছে, তোর্সার নির্দেশ মতো ট্যািক্স ড্রাইভারকে বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরতে বলি।


পুরনো আমলের দোতলা বািড় তোর্সাদের। নীচের তলার বসার ঘরে বসেছি। তোর্সা ইতিমধ্যে দাদা, বউদি, বাবার সঙ্গে আলাপ করিেয় দিেয়ছে। পরিচয় দিেয়ছে অফিসের সিনিয়র কলিগ বলে। সিনিয়র হঠাৎ জুনিয়রের বািড়তে আড্ডা কেন মারতে এসেছে, এর ব্যাখ্যাটা ওরা কী ভাবে করছে জানি না। আমার সঙ্গে অবশ্য সহজ ভাবেই কথা বলল। মােয়র সঙ্গে এখনও আলাপ করায়নি তোর্সা, সম্ভবত উনি এখন বািড় নেই। বউদির সঙ্গে অবিবাহিত ননদ তোর্সার ভালই সম্পর্ক মনে হল, বউদির গাল টিপে আদর করে তোর্সা আলাপ করাল, আমার মিিষ্ট বউদি। জানি না এটা কোনও তোষামোদ কি না। আমি এখন ওদের বািড়র অ্যালবাম দেখছি। চা, স্ন্যাক্স খাওয়া হেয় গেছে। ছোট বাইরে পাচ্ছে, টেনশনে অনেকক্ষণ করা হয়নি। তোর্সাকে বললাম, একটু টয়লেটে যাব।


আসুন না। বারান্দার শেষে যে দরজাটা, ওইটা।


জলবিেয়াগ করতে করতে একটু যেন বেশিই নির্ভার লাগছে। যাক, ঘোলাটে ভাবে হলেও, আমাদের সম্পর্কটার কেয়ক জন সাক্ষী রইল।


টয়লেট থেকে বেরোতেই থতমত খেলাম। নীল ম্যািক্স পরা এক বৃদ্ধা আমার দু’হাত দূরে। একেবারে মুখোমুখি। শরীরী ভঙ্গিতে ঘোর অস্বাভাবিকতা। চাউনিতে অদ্ভুত আক্রোশ। বলে উঠলেন, এখানে কী চাই? কেন এখানে?


উচ্চারণ স্পষ্ট নয়। কেমন যেন ঘরঘরে। আমার গলা শুকিেয় কাঠ। পােয় তেমন জোর পাচ্ছি না। অনেক দিন পর নির্ভেজাল একটা ভয় আমায় বিবশ করেছে।


নিস্তার পেলাম তোর্সার এসে পড়াতে। আমার দেরি দেখে হয়তো বেরিেয় এসেছিল বারান্দায়। ধমকের গলায় বলে উঠল, মা, ওঁকে আসতে দাও। ঘরে যাও তুমি। যাও বলছি।


সরে গেলেন মহিলা। তবে ঘরে গেলেন না। উেল্টা দিকের দেওয়ালে হাফ বডি সাইজ আয়না। সামনে দাঁিড়েয় নিজেকে খুঁটিেয় দেখতে লাগলেন। তখনই লক্ষ করলাম, তোর্সার মােয়র চুলে বিশাল জটা। যেন একটা গোসাপ ঝুলে আছে ঘােড়। আয়নার নীচের র্যাক থেকে চিরুনি তুলে নিলেন। তোর্সা আমাকে বলল, চলুন, ঘরে চলুন।







েফর আগে† জায়গায় এসে বসলাম। ধাক্কাটা এখনও সামলে উঠতে পারিনি। তোর্সা বলতে থাকল, মাকে নিেয়ই সমস্যা। অফিস বাদে আমাকেই দেখাশোনা করতে হয়। দাদার বদলির চাকরি। যখন তখন অর্ডার এসে যেতে পারে। বউদিও চলে যাবে। তখন চাকরিটা কী করে চালাব ভাবছি। বাবার বয়স হচ্ছে, একা মাকে সামলাতে পারে না।


বউদিকে তোষামোদের কারণটা ধরতে পারছি। ধাতস্থ হেয়ছি একটু। তোর্সাকে বলি, ওঁর কথা তো আমায় কিছু বলোনি! কবে থেকে এ রকম?


প্রায় পনেরো বছর। বাবা এক বার দেনার দােয় আমাদের কাউকে কিছু না বলে পালিেয় গিেয়ছিল। ধারের ব্যাপারটাও আমরা জানতাম না। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বাবার নামে নানা রকম কথা বলতে লাগল। বেশির ভাগই খারাপ সম্ভাবনার কথা। সে সব সহ্য করতে না পেরে পাগল হেয় গেল মা। বাবা ফিরে আসার পরও সুস্থ হল না। বুঝলাম, অসুখ তা হলে এখানে।


ফিরে এসেছি বািড়। তোর্সাদের ওখান থেকে বেরোনর সময় দেখেছিলাম, বারান্দায় আয়নার সামনে দাঁিড়েয় খুব আগ্রহ ভরে চুল আঁচড়াচ্ছেন তোর্সার মা। চিরুনি ঘােড় এসে থেমে যাচ্ছে বার বার। বড় একটা ঁসিদুরের টিপ পরলেন।


অন্যান্য দিন আরতি বিছানায় আসার আগে ঘুমিেয় পিড়। আজ জেগে রেয়ছি। আরতি এল। মশারি গুঁজে শুতে গিেয় দেখে আমার চোখ খোলা। নাইট ল্যােম্পর আলোকে হারিেয় দিেয় মিলন সম্ভাবনায় উজ্জ্বল হল ওর মুখ। বুকে টেনে নিই আরতির মাথা। আঙুল চালিেয় দিই ওর চুলে। থেমে যায় আঙুল। হঠাৎ যেন বুক ফাঁকা হেয় যায় আমার। তোর্সার বাবার মতো আমি তো নিরুেদ্দশ হেয় যাইনি এখনও। জোর লাগাই আঙুলে। আরতি বলে, উফ্‌, লাগছে।


কথা শুনি না। বলি, এত জট কেন? কবে পাকালে? আরতি বলে, হবে না, সংসারে কত চিন্তা! মাথা থেকে উপচে চুলে জিড়েয় যায়।


এই জট থেকে আমাকে বেরোতেই হবে। আঙুলগুলো যেন হরিণের প্রাণ পেেয়ছে। জঙ্গলের লতাপাতায় আটকে গেছে শিং। খানিক দূরে আরতির মতো শান্ত টলটলে একটা হ্রদ। আমাকে পৌঁছতেই হবে ওখানে।


ছবি: সায়ন চক্রবর্তী