Thursday, February 11, 2010

জন্মান্তর - রফিকুর রশীদ

ভোটে পাস করার পর থেকে তারাবানুর চোখে ঘুম নেই। ঠিক আনন্দে নয়, বেদনার অভিঘাতে ঘন ঘন উপচে উঠছে দু’ চোখের তটিনি। আঁচলে চোখ মুছে পাশ ফিরে শুয়েও শান্তি নেই, খোকনের বিরামহীন প্রশ্নে আবার তাকে মুখ ফেরাতেই হয়। হুঁ, হ্যাঁ, না- এসব সংক্ষিপ্ত উত্তরে তার কৌতূহল মেটাতে পারে না, মাথার চুলে হাত চালিয়ে বিলি কাটে তারাবানু, তবু সে চোখ গোল গোল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেনবা অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব খুঁজে ফেরে সেই ক্লান্ত মুুখের মানচিত্রে। মানুষের মুখের প্রতিটি পেশিতে কতো যে আনন্দ-বেদনার দুষ্পাঠ্য ছবি মুদ্রিত থাকে সাত বছরের খোকন তার কতোটুকুই বা জানে! অর্বাচীন বালক সহসা প্রশ্ন করে বসে,
-আব্বার কথা মনে পড়ছে, তাই না মা?


সমগ্র অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে তারাবানুর, যেনবা ধরা পড়ে যাওয়া বেকুব চোর সে। ধরা পড়লেও উদ্ধার পাবার আকুলতা সবার থাকে, তখন হিতাহিত জ্ঞান প্রায় শূন্য হয়ে আসে। তারাবানুও হঠাৎ খোকনের গালে ঠাস করে একটা চড় কষে দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু তখনই তার দু’ চোখে নামে বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউ। আহত খোকন ছেঁড়া লেপের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেললেও তারাবানুর বুকের মধ্যে উথাল পাথাল ঝড়। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে তার চুলের অরণ্যে মমতার চিরুনি বুলায়। এক সময় উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে খোকন ঘুমিয়ে যায়, তারাবানুর ঘুম আসে না। দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয় লেপের ভেতরের উষ্ণতা, বালিশ ভিজে আসে নীরব অশ্রুপাতে।

বাঁশতলি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের ফলাফল হয়ে গেছে সন্ধ্যের পরপরই; কিন্তু সংরক্ষিত মহিলা সদস্যদের ফলাফল চূড়ান্ত হবে আরো দু’টো ওয়ার্ডের ভোট গণনার পর। পুরুষ প্রার্থি ওমর আলী পাস করেছে, তাই নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়ে গেছে। আগের মেম্বর আদম পাঁঠা এবার পরাজিত হয়েছে, আদম আলির পাস করার চেয়ে সেটাই যেন অধিক আনন্দের কারণ হয়ে উঠেছে। নারীঘটিত দোষ আছে লোকটির, ফতোয়াবাজ সেকেন্দার মৌলভীর সঙ্গে তার প্রাণের দোস্তি। তালাকের ফতোয়া হিলা পর্যন্ত গড়াতে পারলেই বর হিসেবে নিরঙ্কুশ প্রার্থি আদম মেম্বর খাড়া হয়ে যায় বুক ফুলিয়ে। গ্রামের মানুষ এসব দেখে-শুনে আড়ালে-আবডালে আদম পাঁঠা বলে ডাকতো, এবার ভোটের মৌসুমে সেই আড়ালের নামটা একেবারে প্রকাশ্যে চলে এসেছে; এতে সে মোটেই লজ্জা না পেয়ে বরং হে হে করে হেসে অভিনন্দিত করেছে নিজের এই নতুন নামকরণ। তারাবানুর শ্বশুর কাবেরুদ্দীন শেখ সেই আদম পাঁঠার সমর্থক। ভোট গণনা শেষ হলে ওমর আলির কর্মী-সমর্থকরা যখন উল্লাসে ফেটে পড়ে, বিজয় মিছিলের আয়োজন করে, সেই সময় প্রাইমারী স্কুলের উত্তর কোণায় সন্ধ্যে বেলার আলো আঁধারিতে খোকনকে ওর দাদার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারাবানু বিস্মিত হয়; ওরা দু’জন কি করছে ওখানে!

তারাবানুর এটুকু ভাবান্তর তার সমর্থকদের নজরে পড়ে না। তাদের উদ্বেগ অন্যান্য কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে। উদ্বিগ্ন, কিন্তু কেউ হতাশ নয়। প্রবল বিরোধিতা আর মিথ্যাচারের মধ্যেও বাঁশতলিতে দেড় শ’ ভোটে এগিয়ে আছে, অন্যান্য কেন্দ্রেও খারাপ করার কথা নয়। আশপাশের সব কটা গ্রামে তাদের সমিতি আছে, তারাবানু সমিতির প্রার্থি, সমিতির সদস্য সব মহিলা তার জন্যে কাজ করছে। কেবল স্বর্ণগাছির মোমেনা সমিতির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্বামীর যুক্তি এবং বাপ-চাচার বড় গোষ্ঠীর জোরে ভোটে দাঁড়িয়েছে। তবু মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোমেনার সঙ্গে নয়, মধ্যপাড়ার শেফালি খাতুনের সঙ্গে হবে। এসব নানাবিধ সম্ভাব্যতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে চলতেই স্বর্ণগাছির ফলাফল এলে দেখা গেল কলস মার্কা দুশ’ একাত্তর ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছে। তারাবানুর কর্মী-সমর্থকরা সেই শীতের রাতেই বিজয় মিছিল বের করতে চায়, কে একজন গাঁদা ফুলের মালা এনে এরই মাঝে তারাবানুর গলায় পরিয়ে দেয়, তারাবানু হতবিহ্বল। বৃদ্ধা খতেজান বেওয়া কোন ফাঁকে এই ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

তার বুক চাপড়ানি মাতমে কেউ কেউ বিস্মিত হয়- আজকের এই দিনে বুড়ি এভাবে কাঁদছে কেন! কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার, বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীরটা দিয়ে জড়িয়ে ধরে তারাবানুকে এবং তখনই সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তারবানু জানে এ কান্না মোটেই বেদনার প্রকাশ নয়, উত্তেজনাকর যে কোনো মুহূর্তে খতেজানের বুক ফাটা অভিব্যক্তি এই রকমই হয়। তবু অবোধ সেই কান্না প্রবাহ নীরবেই সংক্রমিত হয়, তারাবানুরও চোখ ভিজে আসে। একবার ভাবনা হয়, বুড়ি এভাবে কাঁদে কেন?

আনন্দমুখর জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে সে ভাবনা বিস্তৃতি লাভ করে না। তারাবানুর চাচাতো ভাই আক্কাছ গতকাল পর্যন্ত তারাবানুর বিরোধিতা করেছে, সত্যি বলতে কি তার প্রশ্রয়েই সমিতির অফিসার ইমরান ভাইকে জড়িয়ে রটানো কুৎসিৎ কেচ্ছাটি দ্রুত ডালপালা ছড়াতে পেরেছিল; সেই আক্কাছ হাত তুলে আঙ্গুল নাড়িয়ে বক্তৃতা দিতে উদ্যত হয়। সে বিজয় মিছিল মোটেই বিলম্বিত করার পক্ষে নয়। উপস্থিত জনতারও সেই মত। কিন্তু আক্কাছের কথা শুনবে কে! সবাই চাইছে তারাবানু কিছু বলুক। সে যা বলবে তাই হবে।

তারাবানুর বাপ হাত উঁচিয়ে কী যেন বলতে চায়, কিন্তু সম্মিলিত কোলাহলে তা হারিয়ে যায়। অবশেষে তারাবানু কয়েক পা পিছিয়ে ঘরের সামনের খোলা দাওয়ায় উঠে দাঁড়ায়, পায়ের তলায় যেনবা সাতই মার্চের ঐতিহাসিক মঞ্চ। ডান হাত উঁচু করে সবাইকে শান্ত হতে বলে, নড়ে ওঠে তর্জনী। সত্যি শান্ত হয় জনতা, যেন বা মহান নেতার শক্তিশালী অঙ্গুলি নির্দেশ। তারাবানু ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে, এতোগুলো মানুষ তারই কথা শুনছে! মেরুদন্ডের ভেতরে শির শির করে ওঠে। সে সরাসরি প্রশ্ন করে বসে- আপনারা আমার কথা মানবেন? জনতা হৈ চৈ করে সম্মতি জানালে সে আবার বিপাকে পড়ে- কী কথা বলবে সে? তার যে কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে কান্নায়! খতেজান বেওয়াই কি তবে এ জন্য দায়ি? হাতের তালুতে চোখের কোণা মুছে সে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়; কুয়াশা-জোছনায় মাখামাখি মুখগুলোর দিকে একে একে তাকায়, তারপর দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করে- আপনারা ভোটে পাস করেছেন, কাল থেকে আপনারা যা বলবেন, আপনাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি তাই করবো। কিন্তু আজ আমার কথা শুনতে হবে। জনতা চিৎকার করে সম্মতি জানায়, শুনবে। তারাবানু ধীরে ধীরে তার অভিমত ব্যক্ত করে- ভোটে পাস করা মানেই বিজয় লাভ করা নয়। আমাদের বিজয় এখনও সামনে। কাজেই আজ কোনো মিছিল নয়, রাত অনেক হয়েছে, সবাই বাড়ি ফিরে যান।

রাখাল বালকের যাদুর বাঁশি যেনবা বেজে উঠে। শিং বাঁকানো বেয়াড়া বলদও মুখ নামিয়ে ঘরে ফেরে। ভেতরে ঘোঁৎঘোতানি যতোই থাকুক, অবাধ্য কেউ নয়। ফিরে যাওয়া মানুষের দিকে তাকিয়ে তারাবানু নিজের ক্ষমতাকে প্রত্যক্ষ করে বটে, কিন্তু বুকের নদীতটে আছড়ে পড়া কান্নার অভিঘাতকে কিছুতেই মুছতে পারে না। সারাদিনের ক্ষুধা ক্লান্তি সব মিথ্যে হয়ে যায় ঐ কান্নার কাছে। খেতে বসে খাবার ঢোকে না, খাদ্যনালির মুখে দলা পাকিয়ে আটকে যায়। খোকনকে খাইয়ে নিয়ে এসে শুয়ে পড়ে। তারাবানুর বাপ একবার নির্বাচনী পর্যালোচনা সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিল, মেয়ের অনাগ্রহের কারণে সেটা এগোয়নি। সমিতি করতে শুরু করে মানুষের সহমর্মিতা, উদারতা, মহানুভবতার শিক্ষা পেয়েছে তারাবানু, এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না এলে মুদ্রার উল্টোপিঠ এভাবে চেনা হতো না। মানুষের নীচতা, ক্ষুদ্রতা, হিংস্রতা যে আর কারো সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে না, সে শিক্ষাও পেয়েছে চরম মূল্য দিয়ে। নির্বাচনী পর্যালোচনার কথা উঠলেই এই ভয়াবহ অন্ধকার দিকের কথাও চলে আসবে। তারাবানু সেটা কিছুতেই চায় না।

রাত গভীর হয়েছে। তারাবানু এখন ঘুমাতে চায়। সকালে উঠে দশ মাইল পথ ভেঙ্গে তাকে মেহেরপুরে যেতে হবে। দু’ মাইল হেঁটে গিয়ে বামুন্দি থেকে বাসে উঠতে হয়। বাসে চড়ার লোভে খোকন ঝুল ধরেছে, সেও যাবে। বাসে ওঠাই কি সহজ কথা! ঝাঁকাভর্তি মুরগির মতো গাদাগাদা মানুষ গিজ্গিজ্ করে বাসের মধ্যে। তার মধ্যে খোকনকে নিয়ে যাবে কি করে! বাপের জন্যে ছেলেটার মন খারাপ করছে কিনা কে জানে! সে কথা আবার মুখ ফুটে বলে না। এটুকু ছেলে, কি বুঝে পেটের মধ্যে কথা চেপে রাখে। উল্টো তার মায়ের কাছেই চাপা মারে- আব্বার কথা মনে পড়ছে? কেন, আমার মনে পড়লেই বা তোর বাপের কি? তারাবানু গজ্গজ্ করে- তার নিজের চোখ নেই, নিজে দেখতে পায় না, বুড়ো বাপের ছানিপড়া চোখে দ্যাখে। দশ বছর সংসার করার পর আমি হলাম অসতী। সমিতির মেয়েরা হলো বেশ্যা। বাপে বললো, আর সে তাই বিশ্বাস করে বসলো! সমিতি করে টাকা জমাই, ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগি পালি, এইসব সাত ঝামেলা করে যা লাভ হয়, তা কার সংসারে লাগে! সমিতির স্কুলে লেখাপড়া করতে গেলেই মেয়েরা বেশ্যা হয়ে যায়! তোমার ছেলেটাকে বই নিয়ে কে বসায়? এসব তোমার চোখে পড়ে না? মনের গজ্গজানি থামিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলায় তারাবানু- না, তোকে কোর্ট কাছারিতে যেতে হবে না। যেতে হয় আমিই যাব।

আইনের মারপ্যাঁচ বোঝে না তারাবানু, তবু মামলা লড়তে হচ্ছে। চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল তার শ্বশুর, অথচ হাজত খাটছে খোকনের বাপ কুদ্দুস দর্জি। হ্যাঁ, তার সামনেই ঘটেছে, সে কোনো প্রতিবাদ করেনি। বরং সে পুরানো দাবিই জোর দিয়ে জানিয়েছে, বাপের বাড়ি থেকে মেশিন কেনার টাকা নিয়ে আসিস, দর্জির কাজ শিখে নাগাদ সে পরের দোকানে পরের মেশিনে কাজ করছে, সেলাই মেশিন তার একটা দরকার। সমিতির সঙ্গে আলাপও করেছে তারাবানু, কিন্তু কুদ্দুস কিছুতেই ঋণের কিস্তি গুনতে রাজি নয়। তারাবানু নিজের উপার্জন থেকে সেই ব্যবস্থা করতে চায়, তারপর সেলাই-মেশিনের ঋণ নেবে এই রকম ভেবে রেখেছে। কিন্তু কুদ্দুসের বাপ পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনলেও হবে না। ছেলের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ তার- বেশ্যা মাগী নিয়ে ঘর করতে হয়, অন্য কোথাও করিস। আমার ভিটেয় জায়গা হবে না।

এরপর আর তারাবানু সেখানে দাঁড়ায়নি। স্বামীর মুখ পানেও তাকায়নি। একই গ্রামের অন্য পাড়ায় বাপের বাড়ি, খোকনের হাত ধরে চলে এসেছে। খুব দুর্ভাবনা হয়েছিল, খোকনকে হয়তো আসতেই দেবে না। কিন্তু কেউ এতোটুকু বাধা পর্যন্ত দিলো না। নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকলো কুদ্দুস। সব ঘটনা শুনে সমিতির জেলা সমন্বয়কারী ইমরান ভাই নিজে ছুটে গেছেন কুদ্দুসের কাছে, বুঝাতে চেষ্টা করেছেন, সব শেষে সেলাই মেশিন কিনে দেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দিয়েছেন, কিছুতেই কাজ হয়নি। সে পূর্বাপর নির্বিকার। মুখ খুলতেই রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত তারাবানুর শ্বশুর অপমানের তীব্র চাবকানিতে রক্তাক্ত করে- ও বৌ আমরা তালাক দিলাম, ইবার আপনেরা ঘর সংসার করেনগা।

এতো কিছুর পর তারাবানুকে মামলা করতে হয়েছে। সমিতি উদ্যোগ নিয়ে মামলা দিয়েছে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের। এভাবে মামলা মোকদ্দমায় জড়াতে তার ইচ্ছে হয়নি। মেয়ে মানুষ, কোর্ট কাছারি দাবড়ে বেড়াবে কীভাবে! সমিতির লোকজন নানান কথা বুঝিয়েছে, নারী অধিকারের কথা বলেছে, তবু তার মন সায় দেয়নি। কিন্তু মাঝে একদিন কুদ্দুসের দোস্ত হাশেম এসে মিথ্যে মামলার হুমকি দিয়ে গেলে সে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। সাত দিনের মধ্যে মেশিন কেনার টাকা দিতে হবে, না হলে কুদ্দুসই নাকি তার নামে চুরির মামলা দেবে। চুরি? বুঝতে সময় লাগে তারাবানুর। হাশেম বুঝিয়ে বলে, সে নাকি শ্বশুরবাড়ি থেকে সোনাদানা চুরি করে পালিয়েছে। মাথার চাঁদি গরম হয়ে যায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়- খোকনের আব্বা এই কথা বলেছে? নিজে মুখে বললো? কী এমন সোনাদানা আছে ঐ বাড়িতে!

আদম পাঠার সাগরেদ এসে আগের দিন শাসিয়ে গেছে- তার শ্বশুর কাবেরুদ্দীন শেখ সালিশ ডেকে তার ফস্টিনস্টির বিচার করবে। বাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার পর আবার বিচার! তারাবানু বুঝতে পারে ষড়যন্ত্র অনেক অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই বিপর্যস্ত অবস্থায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উদ্যম একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত তাদের সমিতির, সে নিজেও অনেক আগে সম্মতি জানিয়েছে, মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়ে গেছে, পিছিয়ে আসার সুযোগ কোথায়? ইমরান ভাই শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন- নির্বাচনও করতে হবে, সেই সঙ্গে একটা মামলাও করতে হবে। সেই মামলার সাক্ষীর দিন পড়েছে আগামীকাল। কোর্টে গিয়ে দাঁড়াতে হবে খোকনের আব্বার মুখোমুখি। হাজতে বসে সে কি এই নির্বাচনের ফলাফল জানতে পেরেছে? কিন্তু তারাবানু এভাবে ভাবছে কেন? ঐ লোকটির জানা অথবা না জানাতে তার কি এসে যায়? তাকে জানানোর জন্যেই কি এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এতো দূর আসা?

এতোক্ষণে তারাবানুর অন্তরে আরো একটি মুখ ভেসে আসে। অনেক কাজ তার। গোটা জেলা চষে বেড়াতে হয় তাকে। প্রতিটি সমিতির টনটনে খবর রাখা চাই। তবু আজকের এই দিনে একবার দেখা পাওয়া যাবে না! নির্বাচন জমে ওঠার আগেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। নেপথ্যে সব খবর ঠিকই রাখেন। ফলাফলও নিশ্চয় পেয়ে গেছেন। তাইবলে আজও তাকে সামনে পাওয়া যাবে না! মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়তে হয় সে তো তার কাছেই শেখা! তার সঙ্গে দেখা না হলে জীবনের এই গদ্যময় ধারাপাতের পাঠ নেয়াই হতো না! এই যে রুখে দাঁড়ানো, তার মূল্যই আলাদা- কোথায় ভেসে গেছে আদম পাঁঠার সালিশের মজলিশ, হাশেম আলির মিথ্যে মামলার শাসানি! মানুষ একা একা দাঁড়াতে পারে না, উঠে দাঁড়াবার জন্যে তার সঙ্গ চাই, সংগঠন চাই- তারাবানু এসব শিখেছে ইমরান ভাইদের সমিতি করতে এসে। আর সেই মানুষটি এভাবে নিজেকে সরিয়ে রাখবে কেন- এ কথা ভাবতেই আবার দু’ চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। খোকনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে শোয় তারাবানু, একটুখানি ঘুমানো দরকার তার, সকালে উঠে মেহেরপুরে যেতে হবে। এদিকে রাত শেষ হয়ে এলো, একটুখানি চোখের পাতা জুড়িয়ে নেয়া দরকার।

কুয়াশা ভেজা শীতের রাত ভারি হয়ে এলে এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন একটুখানি তন্দ্রা নেমে আসে তারাবানুর চোখে। নানারকম হিজিবিজি স্বপ্নে সেই তন্দ্রা ছিঁড়ে ছুটে একাকার হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে কাঠ, যেন কতোকাল পানি খায়নি। মন্ডলপাড়ার মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি এসে আছড়ে পড়ে। ছেঁড়া লেপের উষ্ণতায় ছটফটানি ধরে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে ইচ্ছে করে তারাবানুর। কিন্তু তখনই খোকন পাশ ফিরে ঘুমের ঘোরে দু’ হাতে গলা জড়িয়ে ধরে। তারাবানু আবার বন্দি হয়ে যায়। পাখিরা জেগে ওঠে কলকণ্ঠে, ঘোষণা করে দিনের সূচনা। বেড়ার চাটাইয়ের ফুটো দিয়ে উঁকি দিয়ে যায় আঁধার চেরা প্রভাত। উঠোনে কার যেন গলা খ্যাকারি। কান খাড়া করে তারাবানু। একবার, দু’বার। খুব চেনা এই ধ্বনি। কিন্তু এই সকালবেলায় এখানে কেন? গলা থেকে ছেলের হাতটা নামিয়ে রেখে উঠে বসে বিছানায়। তখনই উচ্চকণ্ঠে ডাক ভেসে আসে,

-খোকন! কইরে দাদু, এখনো উঠিসনি?

খোকনের কাল যেন অতি সতর্ক এবং প্রস্তুত ছিল এই ডাক শোনার জন্যে। ধসমস করে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ রগড়ায়, নিচু কণ্ঠে জানায়- মা, দাদা এসেছে।

কৃত্রিম কাশির ধ্বনিতে বাইরে আবারও গলাখ্যাকারি শোনা যায়। তারাবানু নির্বিকার। পরণের এলোমেলো বাসি কাপড় গোছাচ্ছে, মাথার পাশে রাখা গায়ের চাদর খুঁজছে। এরই মাঝে আবার আহ্বান আসে,

-কইরে খোকন, বৌমা কই!

এক লাফে তিড়িং করে ঘরের বাইরে চলে আসে খোকন। ততোক্ষণে উত্তরপাড়ার মসজিদ থেকে নামাজ সেরে বাড়িতে পা রাখে খোকনের নানা, তার চোখে অবিশ্বাস এবং কৌতূহল,

-আরে বেয়াই, আপনি এই সাতসকালে! এই খোকন, মাকে ডাক! দাদাকে বসতে দে!

খোকনের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ঘরের ভেতর থেকে কাঠের টুল এনে বসতে দেয়। আবার ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ওর দাদা টুল টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে,

-হ্যাঁ, সকালে মানে, আমি তো ভেবেছিলাম মসজিদ থেকে আপনার সঙ্গেই আসবো। তা আপনি তো আবার আমাদের মসজিদে যান না।

-যাবো যাবো। এই যে ভোটভাট বেরিয়ে গেল, আবার যাবো।

বৃদ্ধ যতো সহজে উচ্চারণ করে, গ্রাম্য বিসংবাদের বিষয়গুলো ততো সহজে নিষ্পত্তি হবার নয়। এর নানামুখি আঘাত আছে, কোনো কোনোটি স্থায়ী দাগ কেটে যায়। নির্বাচনী উত্তেজনায় দুই পাড়ার সমাজ পৃথক হয়ে গেছে, এমনকি মসজিদ পর্যন্ত। কাবেরুদ্দীন শেখ সমাজের এই ভেদরেখা এক লাফে ডিঙ্গাতে চায়।

-রাতেই আসতাম বেয়াই, আসিনি সমাজের ভয়ে। তারপর ভাবলাম, কিসের ভয়- আমার নাতি, আমার বৌমা আমি ঘরে নিয়ে যাবো, তাতে সমাজের কি!

-কিন্তু বেয়াই, জামাই বাবাজি ঃ

-কেন, বৌমাই তাকে হাজত থেকে ছাড়িয়ে আনবে। স্বামী-স্ত্রীর ভুল বুঝাবুঝি হয় না?

-হয়, সবারই হয়। তালাকের ব্যাপারটা তাহলেঃ

হাসিতে ফেটে পড়ে তারাবানুর শ্বশুর,

-মুখের কথায় তালাক হয়? দেশে আইন-কানুন আছে না?

আবার হাসে খ্যাক খ্যাক করে, যেন ভারি এক কৌতুককর বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে। তার হাসির গমকে ভোরের নরম আলো কেঁপে ওঠে থরথর করে। এতোক্ষণে তারাবানু এসে দাঁড়ায় মুখোমুখি,

-ও বাড়িতে আমার আর যাওয়া হবে না।

-কেন? দুই বৃদ্ধ চমকে ওঠে যুগপৎ।

-কারণ আমি অসতী।

কাবেরুদ্দীন শেখের মুখ থেকে হঠাৎ ঘনিয়ে আসা মেঘের আওলা সরে যায়। আবার হেসে ওঠে গলা কাঁপিয়ে,

-ভোটের বাজারে ঐ রকম কতো কথা হাওয়ায় ভাসে। সব কথা কানে তুললে চলে?

-না, ভোটের বাজারের কথা নয়। তারাবানু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে- আমি নিজেই বলছি, আমি অসতী।

-আমার উপর রাগ করে তুমি এ কথা বলছো বৌমা!

-না, রাগ করে না। আমি তো জানি, কী আমি।

-ওসব বাদ দাও তো মা। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। চলো।

-তার মানে আমার সতীত্ব নেই তা জেনেও আমাকে ঘরে নেবেন?

-আহা, তুমি তো ইচ্ছে করে ঃ

-তাহলে কারা আমাকে বেইজ্জতি করেছে সে কথা আপনিও জানেন, আমিও জানি, তাই তো? তাদের আমি দেখে নেব, তারপর অন্য কথা।

-এসব তুই কি বলছিস মা? ডুকরে ওঠে তারাবানুর বৃদ্ধ পিতা।

তারাবানু শক্ত খট্খটে। তার চোখে-মুখে অন্য ছবি, একেবারে অচেনা ছায়া। তার জন্মদাতা পিতা কিম্বা শ্বশুর কেউ কখনো এই ছবি দেখেনি। লেজে পা পড়া ক্রুদ্ধ সাপ যেন বা। নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগে আদম পাঁঠার পরামর্শে প্রতারণার ফাঁদ পেতে একদিন তার নারীত্বের অপমানে উদ্যত হয় এ গ্রামেরই তিনজন অমানুষ। তারাই আবার শতমুখে রটিয়ে বেড়িয়েছে- তারাবানু অসতী। সে নিজে কোথাও মুখ খোলেনি, ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে বদলা নেবার জন্যে।

কাবেরুদ্দীন শেখের কণ্ঠে ধস নামে। সে মুখ নামিয়ে বলে,

-আমাকে তুই মাফ করে দে মা। আমিও তো বাপ!

তারবানু চিৎকার করে ওঠে,

-না। বাপ হয়ে কেউ মেয়ের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। কে বাপ? এই যে আমার বাপ।

জন্মদাতা পিতার গা ছুঁয়ে নতুন করে চিনিয়ে দেয়- এই যে, দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষ, এই আমার বাপ!

তারাবানুর বাপ উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন। কিন্তু তারাবানুর চোখে সে কান্না আর সংক্রমিত হয় না। বরং সহসা নিজেকে বক্ষমুক্ত করে নিয়ে সে ঘোষণা করে- আমি মেহেরপুরে যাবো। মামলার দিন আছে।

-আমার কুদ্দুসের কী হবে মা? সে কি ছাড়া পাবে না?

তারাবানুর শ্বশুর উৎকণ্ঠায় উঠে দাঁড়ান। তারপর ফ্যাস্ফেসে গলায় কারাবন্দি ছেলের ভবিষ্যৎ জানতে চান। কিন্তু তারাবানু কোনো জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে যায়। তাকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

No comments: