Thursday, February 11, 2010

চিত্রা - রাফিক হারিরি

প্রাতঃভ্রমণ করতে বের হয়ে তার মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় আজ।

আকাশ ছেয়ে আছে ঘন মেঘে। বাতাসে ভেজা গন্ধ। তিনি বিরক্ত চোখে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ আকাশের দিকে। সকালে হাঁটতে বের হওয়া তার অনেক পুরোনো অভ্যাস। সূর্য ওঠার আগেই তিনি বের হয়ে পড়েন। রাত শেষের ঘন কালো আধাঁর যখন ছাই রং ধরতে শুরু করে তখন তার চার পাশের অদ্ভুত ছায়াচ্ছন্ন গ্রামটাকে দেখতে খুব ভালো লাগে। সবুজ ধান ক্ষেতের শেষ প্রান্তের ঝাপসা গ্রামটার মাথায় পেজা তুলোর মত হাল্কা শুভ্র কুয়াশা ঝুলে থাকে।

যেন শীতাচ্ছন্ন কোন কিশোরীর গলায় ঝুলে থাকা সাদা দোপাট্টা।

আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। বৃষ্টি হতে পারে যে কোন সময়।

আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে তিনি এক মনে হাটতে থাকেন। আজ হাঁটার মধ্যে তিনি কোনো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মেঘলা আকাশ দেখে তার মনটা গেল খারাপ হয়ে। মনের মাঝে শুধু নানা ভাবনা, পোড়া স্মৃতি, বিষন্ন কথামালা, অস্ফুট আর্তি, অব্যক্ত ক্রন্দন, অভিমানে ফুলে ওঠা ঠোঁট আর অশ্রুসিক্ত কিশোরীর চোখের পাপড়ি ঘাই মেরে ভেসে উঠছে। বাতাসে কেমন ভেজা গন্ধ। তার মনটা আজ খুব অস্থির হয়ে আছে। সকালে হেঁটে হেঁটে তিনি ক্লান্ত হন ঠিক কিন্তু তার মনটা থাকে বড্ড ফুরফুরে। তিনি ক্লান্ত হয়ে যখন ঘরে ফেরেন তখন তার শরীর ঘামে লেপ্টে থাকে। যখন গোসল সেরে খেতে বসেন তখন মনে হয় তার চেয়ে সুখী জগতে আর কেউ নেই। নাস্তা সেরে হুকো নিয়ে বসেন তিনি। হুকোর নলে টান দিতে দিতে আধো ঘুম আধো জাগরণ কখনও বা উথাল পাতাল থৈ হীন ঘুমে তলিয়ে যান। এ ভাবেই কাটান সকালটা।

তার পর শুরু হয় কাজ, বিরামহীন কাজ। কত লোকজন আসে তার কাছে। তিনি যান কত লোকের কাছে। কত আব্দার কত নালিশ। কত অভাব কত অভিযোগ। সকাল থেকে সারা দিন তিনি এই সব নিয়েই ব্যাস্ত থাকেন।

প্রাতঃভ্রমণে বের হতে তিনি আজ একটু দেরি করে ফেললেন। গতকাল রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার বালিশ ভিজে এক সার হয়ে গেছে চোখের পানিতে। ষাটোর্ধো এক বুড়ো কিনা স্বপ্ন দেখে কেঁদে বালিশ ভেজায়। তিনি খুব অস্থির বোধ করেন।

আজ একটু বেলা করেই তার ঘুম ভাংলো। রাতে ঘুম হয় নাই ভালো করে। গত দিন তিনেক ধরেই তার ভালো ঘুম হচ্ছে না। কি সব হাবি জাবি দেখে তার ঘুম ভেংগে যায়। প্রাতভ্রমনে বের হয়ে আকাশ ভর্তি মেঘ দেখে একবার ভাবলেন থাক আজ আর বের হবো না। কিতু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে সামনে এগুতে থাকলেন।

কিছুক্ষণ গ্রামের বড় রাস্তা ধরে হাটলেন তিনি। তার পর কি মনে করে আড়া আড়ি ভাবে বিস্তির্ণ ধান ক্ষেতের মোটা আইল ধরে হাটা শুরু করলেন।

গত তিন দিন ধরেই তিনি বৈঠা ছাড়া নৌকার মত ঘুরছেন ছন্দ হীনভাবে। কোন কিছুই একাগ্র চিত্তে করতে পারছেন না। ঘুরে ফিরে তার মাথার ভেতর ভেসে আসছে গৌতমের ছোট মেয়েটা আর ক্ষনেক ক্ষনেক ঠোকর মেরে যাচ্ছে মাথার ভেতর। মানুষের সংগ হীনতা এত কষ্টকর এটা তিনি ইতঃপূর্বে বুঝতে পারেননি। গৌতম তার পরিবার নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গেছে আজ তিন দিন হবে। পুরো বাড়িটা খালি পরে আছে বিরান ধান ক্ষেতের মত। তার বাড়ির বিশাল উঠানের একেবারে দক্ষিণ পারে গৌতম তার পরিবার নিয়ে থাকে। ভাই ব্রাদার, আত্মীয়-স্বজন বলতে এখন গৌতমই সব। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন পুরো বাড়িটা কেমন বিশাল খা খা করছে। গৌতমের ঘরটা কেমন ঘুমিয়ে রয়েছে মৃত শুকনো ঝড়া পাতার মত।

এটা তার পূর্ব পুরুষের ভিটা। বংশগত ভাবেই তার পূর্ব পুরুষেরা বিশাল জমিদারির মালিক। তিনি তার বাবার এক মাত্র ওয়ারিশ। বিশাল সম্পত্বি পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে।সেই সম্পত্বি খাওয়ার লোক নেই। তার উপরে প্রতি বৎসর সম্পত্তি বেড়েই চলছে দ্বিগুন ত্রিগুন আকারে। তিনিও দুহাতে খরচ করে যাচ্ছেন। উদার ভাবে যে যা চাচ্ছে তিনি দিচ্ছেন। কাউকে ধানি জমি লিখে দিচ্ছেন আবার কাউকে টাকা দিচ্ছেন। তবু ও তার ধানি জমির কমতি হচ্ছে না। কিন্তু আল্লাহ তো আর সবাইকে সব কিছু দিয়ে তৃপ্ত করেন না। তিনি করিম মুন্সির বাড়িটা ফাঁকা করে দিলেন। নিরবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতার একটা বলয় তৈরী হয়ে গেল তার বাড়ির চার পাশ ঘিরে। 


তার বাড়ি নিয়ে অদ্ভুত সব পৌরানিক কাহিনি প্রচলিত আছে। গ্রামের লোকজন কিছু করতে না পারলেও বলতে পারে ভালো। কেউ কেউ বলে তার বাড়িটা একটা অপয়া। তা না হলে এই বাড়ির কোন বাসিন্দা দীর্ঘ দিন জীবিত থাকে না কেন। তার পরিবার পরিজন সবাই মরে গেল তাড়াহুরা করে তাকে সম্পূর্ণ একা রেখে। আবার কারো কারো মতে এই বাড়ির উপর মন্দ কিছুর আছর আছে, বাড়ির মানুষগুলো ঠিক সুস্থ নয় পুরোপুরি। সুস্থ হলে মুন্সি বংশের লোক হয়েও কেউ কি আর নিজের বাড়ির প্রধান কামলা রাখে হিন্দু জাত থেকে। আবার প্রতি বৎসর শত শত মন ধান বিকিয়ে দেয় পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে ফাউ। দুষ্ট লোকেরা বলে ‘এইটা হইলো লোক দেখাইন্না কাম। বুজছনা! হাজী মহসীন সাজতে চায়, দানবীর অইবার চায় বেটা কুফা’।

লোকজন কুফা বলুক আর অপয়া বলুক কিংবা বলে বেড়াক এই বাড়ির উপর মন্দ কিছুর আছর আছে, গ্রামবাসী সেটার সত্য মিথ্যা যাচাই করতে চায় না। এই সমস্ত উড়ো কথা শুনতে তাদের খুব ভালো লাগে। গ্রামে নতুন কেউ আসলেই কথায় কথায় বলে ফেলবে, ‘বুঝছেন বাই পারতপক্ষে ঐ বাড়ির সিমানা দিয়া যাওয়ার দরকার নাই। ঐ বাড়িটা একটা কুফা বাড়ি। অত্ত বড় বাড়ি কেউ থাকে না সেখানে। খালি থাহে একটা বুড়া চাচা। আমগ গ্রামের মুন্সি চাচা। দুনিয়ার সম্পত্তি হের, তবে খাওয়ার মানুষ নাই। চাচায় দুই আতে মাইনষেরে দিয়া বেড়ায়। মুন্সি চাচার মাথায় সমস্যা আছে। বুঝলেননি। মনের বুলেও হের বাড়ির ত্রিসিমানায় যাইবেন না। কী অইল! আপনে আমার কথা বিশ্বাস করলেন না! তয় হুনেন মুন্সি চাচার বয়স প্রায় সত্তুরের কাছাকাছি কিন্তু দেখলে মনে অয় চল্লিশ। ঘটনা ডা কি কন দেহি। গটনা ডা অইল আপনের ঐ যে হের উপর আছর আছে হেই আছর হের শইলডারে টাডি বানাইয়া রাখছে। আরো হুনবেন? হের বাড়ির লোকজন অয় বাস্তা বয়সে মরব নয়ত চল্লিশের মইদ্যে মরব কিন্তুক যদি কেউ চল্লিশ পার করতারে তাইলে হের মরন নাই। হেয় বাচব আপনের একশ দেড়শ বছর। মুন্সি চাচার বাপের দাদায় আপনে দরেন মরছে প্রায় একশ কুড়ি বছর বয়সে। শহর থেকে সামবাদিক আইছিল হের ছবি তুলতে। এহন বিশ্বাস করছেননি আমার কতা। কি! এহন বিশ্বাস করলেন না। তয় আরো হুনেন মুন্সি চাচার মুক আর ব্যবহার এমন খারাপ আর কইতে নাই। কতায় কতায় খালি গাইল পারব। গাইল হুনলে মাতার চুল যায় খাড়া অইয়া। মাঝে মইধ্যে মেজাজ খাড়াপ অইলে হাত চালায় মাইনষের উপর। কামলাগো উপর। হের বাড়িত কামলা আর বদলির অবাব নাই। দুনিয়ার বদলি আর কামলারা ভিন গায়ে থেন আহে হের বাড়ির কাম করার লাগি। বান্দা কামলাত আছেই সারা বছর থাহে হের বাড়িতে। তয় মুন্সি চাচার বাড়ির সীমানায় না। হেরা থাকে আপনের ধরেন মুন্সি চাচার বাড়ির পাশেই। চাচায় হেগোরে জায়গা দিয়া দিছে হেইহানে ঘর তুইলা। চাচার বাড়ির সীমানায় তারাগো থাকতে ডর লাগে। চাচার বাড়ির সীমানায় থাকে শুধু গৌতম গুষ। বুজছেন নি হালায় অইল আপনে ধরেন গা হিন্দু, মালু আর কি। হেয় খবর দারি করে বাকি সব কামলাগ উপর। হের উপর খবর দারি করে মুন্সি চাচায়। আর পানেততে চুন খসলে চাচায় এমন দাতানি দেয় আর এমন মুক খারাপ করে হেই সময় চাচার মুখ দিয়া খালি জয়রা পানির মত গাইল বারয়। এমন খারাপ যার ব্যবহার হেয় অইব মাইনষের দুই চোক্ষের বিষ। কিন্তু বাই কি আর কমু চাচায় যখন গাইল পারে তহন আপনে দেইহেন কামলা বেডাডি কেমন বেক্কেলের মত খারাইয়া থাহে আর হাসে। মনে অয় মুন্সি চাচায় গাইল পাইরা তাগোরে মজার কিছু কইতাছে। আর ঐ যে গৌতম এই ডা অইল গিয়া আরেক চিজ। হেরে আমারা কই গাছ। মুর্দা গাছ কন আর জিন্দা গাছ কন একই কতা। হেয় অইল গিয়া গাছের মত। হেরে হাজার বকবেন কোন সমস্যা নাই। মুক দিয়া একটা রাও করত না। খালি চুপ চাপ খাড়াইয়া থাকব আর বলদের মতন হাসব। মুন্সি চাচার সব কামলা একমতন আর ঐ মালু হালায় অইলা গিয়া অন্য মতন। হেয় অইল মুন্সি চাচার মতন। এক বাড়িত থাকতে থাকতে অইছেও এক রকম। বুজলেন না এইডা অইল গিয়া বাড়ির দোষ। বাই আরো কতা আছে ইট্টু ধোর্য ধইরা যদি হুনতেন তাইলে কতাডি কইয়া আমার বুকটা একটু খালি করতাম। হুনেন মুন্সি চাচারে আমি একদম সইয্য করতে পারি না। বেডায় একটা চারাল। কিন্তু বাই বিশ্বাস করেন একবার আমার মাইওর (মা) এমুন অসুখ করল, জমি জামা সব বেইচ্চা মাইওর চিকিৎসা করলাম। মায় আর সুস্থ অয়না। ডাক্তারে কয় ডাহাত (ঢাকায়) লইয়া যাইতে। হেনে অনেক ট্যাহা পয়সা লাগব। আমার বুড়া মায় কষ্ট করে। পেটের বেদনায় কান্দে। আমি সহ্য করতে না পাইরা গেলাম মুন্সি চাচার বাইত। বাড়ির দলীলডা লইয়া গেলাম বেচার লাগি। সকাল সকাল তারার মেজাজ থাকে খারাপ। কিন্তু তারপরেও গেলাম। হেয় আমার কতা হুইন না কি করছে জানেননি। আমারে কয় নডির পুতে চালাক কত, আমার কাছে আইছে জায়গা বেইচতে। খাংকির পুতে। বেন্দাডা তোর পুটকি দিয়া দিমু নডির পুত। বাই বিশ্বাস করতেন না হেয় গালি পারে আর কান্দে তারপরে আমারে কয় তর মার অসুখ আমারে আগে কস নাই কেন রে নডির পুত। আমার সামনে বাড়ির দলিলডারে ডিল্লা দিয়া ফালাইয়া হেয় কয় লো আমার লগে। বুঝলেন নি একটু আগে আমারে মা তুইল্লা গালি দিছে। হেয় সব ভুইলা গেছে। আমার মারে নিজে ঢাকায় নিয়া চিকিৎসা করাইলো। আমার বন্দকি জমিডি ছুটানের ব্যবস্থা করল। আমার মায় মরল শেষ বয়সে সুস্থ শরীরে। আহারে বাই বিশ্বাস করেন এই মানুষটা এত চারাল মুখ এত খারাপ তার পরেও যখন মাইনষে হের সামনে খাড়ায় আর হের চোখ দুইটার দিকে তাকায় তখন সবার বুকটা কেমন মুচোর দিয়া উঠে। হেয় মাইনষেরে গাইল পারে আর মাইনষে হেরে কয় চাচা আপনে বাচেন দীর্ঘ দিন। চাচার চোখ দুইটার দিকে তাকালে মনে অয় খড়ায় পুইরা যাওয়া বিরান ধান ক্ষেতের কষ্ট হের বুকে। তহন কেরে জানি অনেক মায়া লাগে চাচার লাগি। আহারে বুড়া মানুষ কি কষ্ট না জানি বুকের ভেতর লুকাইয়া রাখছে। হের সামনে খাড়াইয়া কেউ উচা গলায় কতা কয় না। চেয়ার ম্যান হুদ্দা হেরে মাইপা কতা কয় সব সময়। বুজলেন নি বাই এই সব অইল হের উপর খারাপ কন আর বালা কন যেই জ্বিন ডা আছে তার আছরের পরভাব। এহন বিশ্বাস ক রছেন নি আমার কতা। বিশ্বাস না করলে আপনে আপনের রাস্তায় আডেন আমি আমার রাস্তায় যাই।’

সত্য মিথ্যা যাই হোক এই সমস্ত উপকথা শীত কালিন সন্ধ্যার কড়কড়ে শুকনো খেড় কুটা পোড়ার রহস্যময় গন্ধ নিয়ে ধোয়ার সাথে মিশে ছড়িয়ে পরে গ্রাম কে গ্রাম। ধীরে ধীরে তার রহস্যময়তা কিংবা অস্পষ্টতা, আর উদারতা এবং দানশীলতার কারণে তিনি হয়ে পড়েন কিংবদন্তি।

এই সমস্ত উপকথা কিংবা উড়োকথা সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন একটা সময় ছিল যখন তার এই বাড়িটা লোকে গম গম করত। তার বাবা, মা, বড় আব্বা মানে তার বাবার দাদা, তার বড় দুই আবিহাইস্তা বোন, বাড়ি ভর্তি কামলা। করিম মুন্সির বয়স তখন কত হবে চোদ্দ কি পনের। বাড়ির ভেতর হৈ চৈ সব সময় লেগেই থাকত। এত চিৎকার হৈচৈ মুন্সির লাগত অসহ্য। তার পছন্দ ছিলো নিরবতা। সে অধিকাংশ সময় বাড়ির পেছনে বিশাল দীঘির ঘাটে চুপ চাপ বসে থাকত। দীঘির কালো গভীর পানিতে দারখিনা মাছ লুটো পুটি করে, সে বসে বসে সেসব দেখত। কখনো কখনো পুকুরের কালো জলে ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘ কদম গাছের ছায়া পড়ত। সে বসে বসে পানিতে হাত নেড়ে কখনো সেই ছায়া ঢেউয়ের আঘাতে ভেংগে ফেলত আবার কখন ও মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকত সেই ছায়ার দিকে।

বাড়ির ভেতর থেকে যখন হৈ হুল্লোর ভেসে আসত তখন সে পুকুর পারে বসে মনে মনে ভয়ংকর এক প্রার্থনা করত। বিড় বিড় করে শুধু বলত আমি চাই নিরবতা। পৃথিবীর তাবত মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও আমি নিরবতা চাই। এত হৈ হুল্লোর আমার ভালো লাগে না। মরে যাক, সব মরে যাক।

তার বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। অসংখ্য স্মৃতির পল্লব নিয়ে একটা বুড়ো বট গাছের মত তিনি শুধু দাড়িয়ে আছেন একা। একটু বাতাস হলে স্মৃতির পাতাগুলো তিড়তিড়িয়ে কেঁপে উঠে।

তার বিশাল উঠোনের উল্টো দিকে শুধু থাকে গৌতম তার পরিবার নিয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি যখন জানালা দিয়ে বাড়ির উঠোনটার দিকে তাকান তখন দেখতে পান গৌতমের বউ উঠোন ঝাড় দিচ্ছে আর তাদের ছোট্ট মেয়েটা বল্গা হরিনীর মত সারা উঠোন জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে। ঘুম থেকে উঠে তিনি উঠোনে নামার সাথে সাথেই গৌতমের মেয়েটা ছুটে এসে বলবে লাইতে বাজির ঘুম হইছি নি?






হগো মাইও ঘুম অইছে।











তয় মনডা এমুন খারাপ কেন।



নাগো মাইও আমি বালোই আছি। তুমি খাইছনি কিছু। লও আমরা কিছু খাই।






সকাল সকাল এই দৃশ্য তিনি দেখতে পাবেন সেই সুখে তার রাতে ভালো ঘুম হতো।







কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে তার অবস্থা এমন হয়েছে যে রাতে ঘুমই হচ্ছে না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠোনটাকে তার মনে হয় কোনো অভিশপ্ত পোড়ো বাড়ি।











সারা বাড়িটা কেমন শুনশান নিরব হয়ে আছে। উঠোন ঝাড়ু দেয়ার জন্য কেউ নেই। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গৌতমের মেয়েটাকে না দেখতে পেরে তার মনটা আরো অস্থির হয়ে পড়ে।











গৌতমের মেয়েটার নাম চিত্রা। চিত্রল হরিনির মতই সে শুধু ছুটে বেড়ায়।







‘কি বাজি সারাদিন এত দৌড়াদোড়ি করেন কেন আপনে, কি এত কাজ?’







‘কাজ না করলে খামু কিগো মা?’







‘কে রে। আমনের এত জায়গা জমি। আমনের আবার কাজ করোন লাগে নি।’







‘তয় কি করতামগো মাইও।’







‘আমনে সারাদিন আমার লগে বইয়া থাকবেন। গয়া গাছটার নিচে বইসা আমরা গফ করমু। জোলাপাতি খেলমু।’







সারা পৃথিবীর সব মানুষের উপরই তার কেন জানি খুব বিরক্তির ভাব। কিন্তু গৌতমের মেয়েটাকে তিনি প্রশ্রয় দেন যুক্তিহীন ভাবে। আহারে মেয়ের জাত। বড় বেশী বেভুলা আর মায়া হরিনী। এগুলোর বুক ভর্তি খালি মায়া।



























গৌতম তার বাড়িতে আছে আজ ত্রিশ কি পয়ত্রিশ বছর ধরে। গৌতমের সাথে তার পারিবারিক বা বংশ কিংবা গ্রাম কে ওয়াস্তেও কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু গৌতম কিভাবে জানি তার স্বত্বার সাথে মিশে গেল। গৌতমকে তিনি বিয়ে দিয়েছেন প্রায় শেষ বয়সে এসে যখন গৌতমের বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে। এক কথায় জোড় করেই তিনি গৌতমকে বিয়ে দিয়েছিলেন।







বিয়ের প্রায় ছয় বছর পর যখন গৌতমের ঘরে একটা মেয়ে হলো তখনই তিনি তার বাড়ির পিছনে ঘাট বাধানো বিশাল পুকুরটা সহ আরো যত খানা খন্দ ছিল সব মাটি দিয়ে ভরে ফেললেন। সবাই অবাক হয়ে ভাবে মুন্সি বাড়ির এই পাগলটার মাথা মনে হয় আর জীবনেও ঠিক হবে না।







তিনি আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গ্রামের শেষ মাথায় গোরস্থানের পাশে চলে এলেন খেয়ালই করতে পারলেন না। তিনি সচরাচর এদিকে আসেন না। গোরস্থান তার পছন্দের জায়গা না। এর আশেপাশে আসলে তার বুকের ভেতরটা কাঁপে। অস্বস্তি নিয়ে তিনি গোরস্থানের দিকে একবার তাকালেন। অনেক আগে একবার তিনি এই গোরস্থানে একটা কবরের উপর কদমের চারা লাগিয়েছিলেন। তিনি মন দিয়ে গাছটাকে দেখলেন। কত বড় হয়ে গেছে।







গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। তিনি দ্রুত গোরস্থান পার হয়ে হাটতে থাকেন। হাটতে হাটতে যখন গ্রামরাস্তায় উঠে আসলেন তখনই দেখতে পেলেন কে যেন ছুটে ছুটে হাপাতে হাপাতে এদিকেই আসছে। কাছে আসার পর তিনি চিনতে পারলেন গৌতম। বেশ অবাক হলেন তিনি। এভাবে ছুটে আসার কারণ কি। সে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে আসল কখন। তিনি ভাবতে থাকেন।







‘কিরে এমনে কুত্তার মতন হাপাইতেছত কেন? কেউ দৌড়ানি দিছেনি?’







‘বায়ে আপনেরে একটু বাইত যাওন লাগব।’











‘কেরে কি অইছে?’







‘চিত্রায় আমনেরে একটু দেখতে চায়।’







‘এই ডাতো বালা কতা। কিন্তু তুই বাইত আইলি কুনসময়। আমারে কিছু কইলি না।’







‘বায়ে আমি চিত্রার নানি বাড়িত থন সোজা আমনের কাছে আইছি। চিত্রার শইলডা খুব খারাপ।’




‘কি অইছে আমার মাইওর। ঐ নডির পুত কতা কছ না কেন?’

‘কালকা বিকেলে চিত্রা ওর নানির বাড়ির পুকুরে ডুবছিল। বহুত কষ্টে ওরে বাচাইছি। এহন হাসপাতালে আছে।’ গৌতমের কথা শুনে তিনি তব্দা খেয়ে যান। বুকের ভেতরে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে।

গতকাল রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উঠে দেখেন চোখের পানিতে বালিশ ভিজে গেছে। কতকাল পর তিনি তার ছোট্ট মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখলেন। তার একমাত্র মেয়ে কুলসুম। যে মাত্র এগারো বছর বয়সে বাড়ির পিছনের ঘাট বাধানো বিশাল পুকুরটায় ডুবে মারা গিয়েছিল। স্বপ্নের মাঝে তিনি কুলসুমকে দেখলেন একটা কদম গাছকে ঘিরে ছুটা ছুটি করছে আর নাচানাচি করছে। নাচতে নাচতেই মেয়েটা হোচট খেয়ে পড়ে গেল। তিনি ছুটে কাছে এসে মেয়েটাকে যখন তুলতে যাবেন তখন দেখলেন এতো তার মেয়ে কুলসুম না এ হলো চিত্রা। মেয়েটা ব্যাথা পেয়েছে কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে কেমন দুষ্টামি করে হাসছে।’

গৌতম তার কথা বলে শেষ করলে সে দেখে ষাটোর্ধ এক বুড়ো পাগলের মত ছুটতে ছুটতে ক্ষেত আইল আর রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। এত দুর থেকেও গৌতম দেখে বুড়ো তার পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ছুটছে। যেন তার হাতে একেবারেই সময় নেই।

গৌতমও তার পিছু পিছু ছুটে যেতে লাগল।

No comments: