Friday, May 14, 2010

নবজন্মের উপাখ্যান - সাইদ হাসান দারা

আজ ২৫ শ্রাবণ, শুক্রবার। বহু বছর আগের এই দিনটির শেষলগ্নে আমার জন্ম। এটা আমি নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছিলাম, জন্মের প্রায় ১২-১৩ বছর পরে, যখন আমি ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি, তখন। ওই সময়টায় আমি বাপ-চাচাদের বইয়ের ভাণ্ডারগুলো গোপনে ভিন্ন ভিন্ন ছলছুঁতোয় হাতড়াতে শুরু করেছিলাম। কারণ গল্প-উপন্যাসের যে কী স্বাদ তা আমি কিঞ্চিৎ হলেও তত দিনে অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। যার কারণে আমি অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি চাইতাম : যেন বই রাখা আলমারিগুলোর তালা সর্বদা খোলা থাকে। কিন্তু আমাদের মতো ছোটদের কথা বিবেচনা করে বড়রা কখনো বইয়ের আলমারিগুলো খোলা রাখা নিরাপদ মনে করতেন না। যদি বই পড়ে পেকে যাই_যাকে বলে অকালপক্ব!

এ কারণে তারা যতটা না টাকা-পয়সা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করত, তার চেয়ে অনেক বেশি সামলে রাখত বইয়ে ভরা কাঠের আলমারিগুলো। একদিন সেই বইবোঝাই একটা আলমারির ভেতরে থেকে পাকা চামড়ায় বাঁধানো হারানো দিনের একটি সুন্দর ডায়েরি পেয়ে খুলেই বুঝতে পারি_আমার মরহুম বাবার ডায়েরি। এরপর বদ-স্বভাবজনিত কারণে পাতা উল্টাতে গিয়ে একটা পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে বাবার হাতের লেখা দেখতে পাই, আজ ২৫ শ্রাবণ, শুক্রবার, আমার দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম। অর্থাৎ স্বয়ং আমি।



জন্মের পর আমার ক্ষেত্রে অন্য সৌভাগ্যবানদের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই আমার কোনো জন্মদিন পালিত হয়নি। কেউ করেনি। ছেলেবেলা থেকে এ নিয়ে আমার ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও কালের কণ্ঠে সেটা উধাও হয়ে যায় এবং সেখানে এমন একটা বোধ জন্মে যায়, যা থেকে আমি বিশ্বাস করি_একটা মানুষ যেদিন মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে শুধু সেদিনই তার জন্ম হয় না। বরং জীবন তাকে বারবার নতুন নতুন জন্মদানে বাধ্য করে। আবার নিষ্ঠুরভাবে হত্যাও করে। সুতরাং জীবনের অতশত কোন জন্ম-মৃত্যুর দিনটা আমি পালন করব? ২৫ শ্রাবণ, ১৮ আষাঢ়, না..?

আমার বিবেচনায় আমার দ্বিতীয় জন্ম, প্রথম জন্মের ১৭ বছর পরের সেই ১৮ আষাঢ়, রবিবারে। তত দিনে আমাদের পৈতৃক বাড়িটা একটা ভৌতিক বাড়ি ছাড়া আর কিছুই না। বহু বছর আগে থেকে একে একে সবই সেই প্রাচীন আমলের দোতলা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশের নানা অবস্থানে এবং সেখানেই জড়িয়ে পড়েছে সংসারের বায়ান্ন প্যাঁচে। অনেকে আসি-আসি, ফিরি-ফিরি একটা অহেতুক আশ্বাস দিয়ে রাখলেও বাস্তবিক কেউই আর ফিরে আসেনি কোনো দিন। আর আমিও ওখান থেকে কোথাও সটকে যেতে পারিনি আমার ভীরুতার জন্য। গিরগিটির মতো শুধু নিজের পরিচিত গণ্ডিতে সুখী। সেখানেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সবচেয়ে বেশি। অচেনা-অজানা বিষয়ে কেন জানি আমার বড় ভয়। আর বোধ করি সেই ভয়টাকে যেন হঠাৎই আমি জয় করে ফেলি, ঘনঘোর সাঁঝের মতো হয়ে আসা, ১৮ আষাঢ়ের সেই মধ্যাহ্নে। অতঃপর আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি : যেন সত্যিই জীবন আমাকে নতুন করে জন্মদানে বাধিত করেছে। আবার প্রকারান্তরে ওইদিনটি আমার প্রথম মৃত্যুদিবসও বটে!

সেদিন দুপুরের খাওয়া সেরে, আষাঢ়ের আকাশটাকে পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে বেশ খানিকটা দমে গিয়েছিলাম। উত্তর-পূর্ব দিগন্ত থেকে ধেয়ে উঠে আসছিল ভয়ানক ঘনকালো থিকথিকে এক মেঘের পাহাড়। এ অবস্থায় সিনেমা হলে গিয়ে কোনো লাভ নেই। এ রকম আবহাওয়ায় মিতু কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারবে না। বাড়ির কেউই তাকে বেরোতে দেবে না। কাজেই সিনেমা হলে গিয়ে সুন্দর করে সেজেগুজে আসা মিতুকে দেখার ও তার সানি্নধ্য পাওয়ার আশাটাকে আমাকে ত্যাগ করতে হয়।

যার কারণে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাওয়ার ঘরটা বন্ধ করে নির্জন বাড়ির লম্বা বারান্দাটা পেরিয়ে শোবারঘরের বিছানায় গিয়ে গলদা চিংড়ির মতো বাঁকা হয়ে শুয়ে প্রকৃতিকে গালমন্দ করি। বছরের এই ঋতুটার অঝোর বৃষ্টি আর মৌসুমি ভেজা বাতাসের দাপটে সব কিছু একাকার হয়ে ওঠে। আমি ফুঁপিয়ে ওঠার মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মিতুই আমার প্রথম ভালো লাগা, আমার প্রথম ভালোবাসা। জনশ্রুতি অনুযায়ী শহরে সে-ই তখন রূপসীদের অন্যতম। গোপালদের পাড়ায় বাড়ি। গোপালের সঙ্গে তার ভারি খাতির। এক রিকশায় কলেজে যাওয়া-আসা করে। হেসে হেসে কথা কয়, সিনেমার গল্প করে, একসঙ্গে দেখে। এ কারণে অনেকে ভাবে, সন্দেহ করে, ওর সঙ্গে ওর গভীর প্রেম। কিন্তু আমি জানি, পাশাপাশি বাড়ি বলে ওর সঙ্গে ওর স্রেফ বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কারণ গোপাল হিন্দু, মিতু মুসলমান।
আমাদের গ্রামে হৃদয়ঘটিত যত অঘটনই ঘটুক না কেন আমি অন্তত দেখিনি এমনকি শুনিনি_কোনো মুসলমান মেয়ে কোনো হিন্দু ছেলের হাত ধরে পালাল। সে জন্য মিতু যদি হিন্দুু হতো এবং গোপাল যদি মুসলমান হতো তাহলে অবশ্যই তাদের নিয়ে আমার মনেও বিষকাঁটার মতো একটা সন্দেহ থাকত। ওদের অবাধ মেলামেশায় মিতুর অন্য পাণিপ্রার্থীদের মতো আমার ভেতরেও ঈর্ষার আগুন ধিকধিক করে জ্বলে উঠত।

কিন্তু তার বদলে আমি এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করি। কারণ গোপাল আমাকে কথা দিয়েছে_কথায় কথায় সে অবশ্যই একদিন মিতুকে পটিয়ে ফেলবে। তারপর তার প্রতি আমার গভীর আনুগত্যের কথা, আমার সুগভীর অনুরাগের কথা, আমার বিরল ও তুলনাবিহীন ভালোবাসার কথা জানাবে এবং তার থেকে আমার ভালোবাসার সম্মতি আদায় করে ছাড়বে।

এ ব্যাপারটা ছাড়াও গোপাল আমাকে প্রেমসংক্রান্ত আরো অনেক উপদেশ দিয়েছে। তার উপদেশ আমি সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করে ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছি। এই যন্ত্রণা বহুদিন যাবৎ বয়ে বেড়াচ্ছে বেচারা গোপাল স্বয়ং নিজে। অথচ তার ভেতরে যে যন্ত্রণা হচ্ছে, সেটাও আবার কারো দ্বারা বোঝা বা অনুমান করা সম্ভব নয়, এমনকি কেউ জানেই না, তার কোনো প্রেমিকা আছে কি না। এ ব্যাপারে সে কোনো দিন কারো কাছে মুখ খোলেনি। কিন্তু তার গোপন ব্যাপারটা আমি হঠাৎ জেনে ফেলি, এমনকি তার গভীরতাটাও চর্মচক্ষে দেখে ফেলি। অতঃপর বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারিনি। কারণ তাদের অপ্রকাশিত প্রণয়ের অগি্নশিখার উচ্চতা তখন এতটাই ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে সে আগুনে আমার নিজেরই পুড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছিল। আর যেন বলাই বাহুল্য সেই হিলিহিল অনল তাপদাহে সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। রাতভর ভেবে চলেছি তাদের কথা_ভালোবাসা এমন! এত দূরও তার স্পর্ধা!

সে রাতে খাওয়ার পর ঘুমানোর আগে একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা হলে বাড়ির বাইরে এসে মোড়ের দোকানটার কাছে যেতেই হঠাৎ দেখতে পেয়েছিলাম, রাস্তার বিজলিবাতির আলো-আঁধারিতে গোপাল সান্যাল হনহন করে হেঁটে আসছে। সে আমাকে দেখে হাতের ইশারায় ডাক দিয়ে বলল_একটু আয় তো, হেলাল ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।

অতঃপর চলার মধ্যে জানায়_তার সন্ন্যাসী দাদুমশাইকে নাকি কেমন দেখাচ্ছে। সন্ধ্যার শুরুতে তিনি ধ্যানে বসেছিলেন। এখনো ওভাবেই বসে আছেন। নড়াচড়া কিছুই করছেন না, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসেরও কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। হয়তো তিনি মরে যেতে বসেছেন।
আমি কিছু বলি না। তার সঙ্গে দ্রুত হাঁটতে থাকি। কথা যেন আটকে গেছে। গোপালের দাদুমশাই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন মানুষদের অন্যতম। তাঁকে দেখায় হুবহু বইয়ের ছবিতে থাকা কোনো ঋষির মতো।

কাছেই হেলাল ডাক্তারের বাড়ি। তাকে বলতেই সে হন্তদন্ত হয়ে তার ডাক্তারি ব্যাগটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। তারপর আমরা যখন দাদুমশাইয়ের ঘরটায় প্রবেশ করলাম, দেখলাম অনেকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আর তিনি তাঁর নির্দিষ্ট বসার অবস্থানে পদ্মাসনে বসে আছেন। স্থির, নিশ্চল। পুরো ঘরটা অপূর্ব এক সুগন্ধে ভরে উঠেছে। কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে যেন গোলাপ আর চন্দনের সুবাস ভেসে আসছে।

হেলাল ডাক্তার দ্রুত এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে দাদুমশাইকে ক্ষণকাল আঙুলে স্পর্শ করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ করে দমহারা গলায় বলল, 'আপনারা শান্ত হোন। সাধুবাবা দেহত্যাগ করেছেন।' তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে আমাদের অবাক করে দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠল।
তার অকস্মাৎ কান্নায় যারা উপস্থিত ছিল, কেঁদে ওঠার সাহস পচ্ছিল না, তারাও তখন মিহিসুরে কাঁদতে শুরু করল। সবার এমন কান্নায় আমার চোখ দুটোও জলে টলমল করে ওঠে। ভেতরে ঝপ করে নেমে আসে অন্ধকার। সেই সঙ্গে কেমন যেন একটা শূন্যতার বাঁশি হু-হু করে বেজে ওঠে, শুরু হয় স্মৃতি-বিস্মৃতির চালচিত্র : সব সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি বড় ভালো লোক বলে সুপরিচিত ছিলেন। অনেকে বলে, আধ্যাত্দিক ক্ষমতাও তাঁর ছিল।

এ মুহূর্তে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে এক অচেনা শ্বেতশুভ্র চুল-দাড়ির সাধুবাবা : যেন তিনি এই মাত্তর হিমালয় থেকে নেমে এসেছেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে সবাই তাঁর দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু সাধুবাবা তাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির কোনো জবাব না দিয়ে বলতে লাগলেন, তাঁর এখন বেলপাতা, তুলসীপাতা আর চন্দন কাঠ চাই। বলেই তিনি ছুটে গিয়ে পদ্মাসনে বসে থাকা দাদুমশাইকে আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে নিজের পুঁটলি থেকে একটা গেরুয়া বের করে শায়িত নিথর দেহটাকে আবৃত করে দিলেন।
বেলপাতা, ফুল ও ফুলের মালা_এই তিনটি জিনিস গোপালকে দ্রুত সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেন তাঁর বাবা। বাবার নির্দেশে গোপাল আমাকে নিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে জানায়, ফুল-মালা কিনতে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই রাতের বেলা বেলপাতা পাওয়াটাই সমস্যা!

_সমস্যা হবে কেন, এটা কি ন্যাড়াদের শহর? এ শহরে কি একটাও বেলগাছ নেই?
নাক টেনে গোপাল বলল, এখন ইয়ার্কি করসি না। ও তুই বুঝবি না। আগে চল, অপর্ণাদের বাড়ি যাই। দেখি, দেয় নাকি। না দিলে তুই বাড়ির পেছন দিকে গিয়ে ওদের বেলগাছ থেকে পাতাভরা একটা ডাল ভেঙে নিবি। তুই মুসলমান, এতে তোর কোনো অমঙ্গল নেই।
_কেন, তোদের ধর্মে রাতে বেলপাতা তোলা বাধা নাকি?
_বাধা তো একটু আছেই। দেখিস না, রাতের বেলায় কেউ গাছ থেকে ফুল, পাতা বা ফল কোনোটাই তুলতে চায় না!
এরপর সে গলা খাদে নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল_তা ছাড়া বেশ অনেক দিন হলো অপর্ণার কোনো খোঁজখবর নিইনি। তারপর ওর দুটো চিঠিরও কোনো জবাব দিইনি। সে জন্য সে হয়তো দু-চারটি বাঁকা কথাও শোনাতে পারে!
আমার মাথার ভেতর ভোঁ-ভোঁ করে কী যেন পাক খায়_অপর্ণা তোকে চিঠি দিয়েছিল? সে কি তোর প্রেমিকা? লাভার?
_হুম! চলার মধ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপাল_এখন চুপ কর। পরে শুনিস। তবে যেন কাউকে এসব বলিস না, বুঝলি!

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা কাত করে চুপ হয়ে যাই। অতঃপর টের পাই একটা বিরহবোধ যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সেই সঙ্গে যেন এক ঈর্ষার অলীক অনলে কোনো ভুুট্টার মতো পুড়তে থাকি। অপর্ণার মতো একটি স্মার্ট ও অবিশ্বাস্য সুন্দরী মেয়ে গোপালের প্রেমিকা!
অপর্ণাদের বাড়ির সম্মুখে এসে গোপাল আমাকে ছেড়ে সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। আমি পরিকল্পনামাফিক নীরবে আরো খানিকটা হেঁটে গিয়ে রাস্তা ছেড়ে ছোট গলি বেয়ে ওদের বাড়ির পেছনে থাকা জঙ্গলটার দিকে আগাই। তারপর নিরাপদ এক অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বেলগাছটার অনুসন্ধান করি। সেখান থেকে নোনায় ধসে যাওয়া প্রাচীরের কারণে অপর্ণাদের উঠোন-বাড়ি আর বারান্দাটা বেশ দেখা যায়।

একজন বৃদ্ধা সেই বারান্দার জলচৌকিতে বসে দুলে-দুলে চাপা কান্নার সুরে মহাভারত পড়ছেন। তার থেকে অদূরের একটা সাবেক আমলের ইজিচেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে অসম্ভব রূপবতী, অপর্ণা। সে হঠাৎ গোপালকে দেখে নায়িকাসুলভ হিন্দি সিনেমার কোনো দস্যুরানির মতো আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে অবাক হওয়া গলায় বলল_তুমি? হঠাৎ কী মনে করে? পথ ভুলে গেছ নাকি? তারপর আসন থেকে উঠে সে দুই হাত ওপরে তুলে ভয়ানক এক আড়মোড়া ভেঙে দুই পা এগিয়ে এসে খানিকটা কুঁজো হয়ে নিচের উঠোনে দাঁড়ানো গোপালের মুখের দিকে তাকিয়ে দোল খাওয়ার মতো দুলতে লাগল।

আমি অনেক দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কী রকম ভয়ানক যৌবন-জোয়ার ফেটে পড়েছে অপর্ণার অপূর্ব শরীরে। গোপাল দাঁড়িয়ে আছে, নিচে। তার মাথার সমতলে অপর্ণার হিমালয় উদ্ধত বুক। শরীরী আন্দোলনে তা যেন থিরথির কাঁপছে। মহাভারত পড়ুয়া বয়স্কা তাঁর পড়া থামিয়ে গোপালকে চিনতে পেরে বললেন_ও, বাবা, তুমি? এসো-এসো, এত দিন পরে আমাদের কথা মনে পড়ল_অপু, ঘর থেকে একটা আসন এনে দে তো, দিদি!
_আমি এখন বসতে পারব না। দুটো বেলপাতা নিতে এসেছি।

গোপালের কথায় অপর্ণা সিনেমার ভিলেনিদের মতো খিকখিকে এক বন্য আওয়াজে হেসে ওঠে। তারপর হাত বাড়িয়ে তার মাথার চুল খামচে দিয়ে তার অসম্ভব সজীব চোখ দুটো পাকিয়ে বলে_তাহলে বলতে হয় ভুল জায়গায় এসেছ, বুঝলে! আমি পার্বতী নই। মহাদেবের মাথায় এই রাতদুপুরে একমাত্র তিনিই বেলপাতা ফেলতে পারেন! তার ঠোঁট দুটো ভারি পাতলা। সম্পূর্ণ মুখমণ্ডলটা পান পাতার মতো।
_অপর্ণা, কিছুক্ষণ আগে আমার দাদু মারা গেছেন!

অপর্ণা সোজা হয়ে দাঁড়াল। সেই সঙ্গে উধাও হয়ে যায় তার আগের সব চপলতা। জলচৌকিতে বসা বয়স্কা হা-হা করে উঠলেন_অ্যাঁ, বলো কি! অমন স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ মানুষ! কাল তো তাঁকে দেখলাম!
_হ্যাঁ, খানিক আগেও তিনি সুস্থ ছিলেন। ধ্যান করতে করতে দেহত্যাগ করেছেন।
_বলো কী, এ তো তাহলে খাঁটি সাধকের মৃত্যু! শুনেছি, তিনি সেই যৌবনকাল থেকেই সাধন-ভজন করতেন।
একটু চাপা গলায় অপর্ণা বলল_কিন্তু বেলপাতা যে গাছে। রাতে বেলগাছে হাত দিতে আছে, দিদা?
_ঠাকুরঘরে গিয়ে দেখ তো, টুরিতে আছে কি না?

অপর্ণা নিঃশব্দে মাথা কাত করে বারান্দা থেকে চলে যায়। দিদা আবার মুখ খোলেন_আচ্ছা দাদুভাই, আমি কি উনাকে একবার দেখতে যেতে পারি?
_হ্যাঁ-হ্যাঁ। নিশ্চয়ই আসতে পারেন।
_অনেকে এসেছে বুঝি?

_না। এখনো কাউকে বলাই হয়নি। শুধু আপনারাই প্রথম জানলেন। তবে আশ্চর্যের বিষয়_তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছুক্ষণ পরই কোত্থেকে যেন একজন সন্ন্যাসী এসে পড়েছেন। সম্ভবত উনিই দাদুর গুরুদেব!
অপর্ণার দিদা বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে_বলো কি! অতঃপর তিনি অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন তারাদের উদ্দেশে বললেন_সাধকের মৃত্যুসংবাদ এভাবেই বাতাসে ছড়ায়!

অপর্ণা ঠাকুরঘর থেকে গোটাকয় শুকনো বেলপাতা খুঁজে এনে গোপালের এত কাছাকাছি দাঁড়ায় যে সেটা দূর থেকে দেখেও আমার ভেতরে দপ করে ঈর্ষার এক নীল শিখা ফুঁসে ওঠে_ওভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে অপর্ণার কি একটুও লজ্জা করে না?
_এতে হবে?
_না। এ তো একেবারে শুকিয়ে গেছে!
_তাহলে! দিদা, গাছে হাত দেব নাকি?
_তুই হাত দিস না! দিদা বললেন_ব্রাহ্মণ মানুষটাই ছিঁড়ে নিক। বেলগাছে ব্রহ্মদৈত্য থাকে। একটা আলোটালো নিয়ে যা!
_আচ্ছা!

অপর্ণা পুনরায় ঘরে ঢুকে একটা চার্জার নিয়ে উঠোনে নেমে বেলগাছটার দিকে হাঁটতে থাকল। তার পেছন নিল গোপাল। আমি আরেকটু আড়ালের দিকে সরে যাই। আগাছায় ভরা বিরাট একটা পতিত। অসংখ ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। সাপখোপ থাকা বিচিত্র নয়। আমি সাবধানে পা ফেলি এবং বারবার পেছনে তাকাই। উঠোন পেরিয়ে অপর্ণা কায়দা করে একটু পিছিয়ে গিয়ে গোপালের পাশে পাশে হাঁটছে। তার সিল্কের ওড়নাটা হাওয়ায় উড়ে গোপালের মুখচোখে আছড়ে পড়ছে, সেই সঙ্গে প্রতি পদক্ষেপে উভয়ের কাঁধ ঠোকাঠুকি হচ্ছে।

বেলতলায় পেঁৗছে অপর্ণা হাতের চার্জারটা নিচে রাখে। আমার মনে হয়, তার বিদ্যুৎ-সাদা আলোয় আশপাশের ঝোপঝাড়গুলোও যেন ক্রমেই রহস্যময় হয়ে উঠেছে। তারা সবাই সন্দেহের অবাক চোখে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে তার অপূর্ব দেহবল্লরী দেখছে। তার নিটোল নিতম্ব বেয়ে তার ভরাট শরীরটাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে।
গাছতলায় দাঁড়িয়ে গোপাল হাত বাড়িয়ে একটা ডাল ধরে সেটিকে নিচের দিকে টেনে নামাতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। ডালটা ভীষণ শক্ত। অতঃপর সে লাফ মেরে উঁচু হয়ে পাতা ছেঁড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না দেখে অপর্ণা তাকে থামতে বলল_রাখো, ওভাবে হবে না। হয় তুমি আমাকে কোলে তুলে ধরো, নাহয় আমি তোমাকে তুলে ধরি!

তার এমন কথায় আমি তো বটেই, সেই সঙ্গে গোপালও যেন কেঁপে ওঠে চারপাশের অন্ধকারে কী যেন খোঁজে। হয়তো আমাকেই তার প্রয়োজন। কিন্তু আমি নিজেকে গোপনই রাখি এবং অপর্ণার অভিমানী কণ্ঠস্বর শুনি_তোমরা ব্রাহ্মণ, তাই আমার ছোঁয়া পাতা তুমি নিতে চাচ্ছ না, তাই তো?
_ওটা তোমার ভুল ধারণা। আমাদের পরিবারে জাতের বিচার নেই!
_খুব আছে। ব্রাহ্মণ-শূদ্র না থাক। বড়লোক-গরিবলোক আছে।
_এসব কী বলছ?
_তাহলে তুমি আর আগের মতো আসো না কেন? আর আমার চিঠির জবাব দাওনি কেন? বলতে বলতে সে ওড়নাটা কায়দা করে প্যাঁচ দিয়ে কষে আমাকে হতবাক করে দিয়ে খপ করে গোপালের কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে মাটি থেকে অনেক উঁচুতে তুলে বলল_নাও, এবার ব্রহ্মদত্যি হয়ে পাতা ছেঁড়ো। তবে সাবধান, কাঁটা খেয়ো না যেন।

আমি ফ্যালফ্যাল করে গোপালের পাতা ছেঁড়া দেখছি। সে দ্রুত হাত চালাচ্ছে। অপর্ণা বলল_হয়েছে নাকি? আর তোমাকে ধরে রাখতে পারছি না। এখন যেন অনেক ভারী হয়ে গেছ!
_হ্যাঁ, হয়েছে। নামাও!
অপর্ণা তাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনল বটে, কিন্তু আগের মতোই জাপটে ধরে রাখল।
_কী হলো, ছাড়ো!
_যদি না ছাড়ি!
_অপর্ণা, প্লিজ, আমার দাদু মারা গেছেন। তুমি ভাবতেও পারবে না এর চেয়ে শোকের আমার কাছে আর কিছুই নেই।
_বুড়োখুড়োদের মরা নিয়ে অত ভাবতে নেই। ওরা মরবেই। বুড়ো হলে মানুষকে মরতেই হয়। এতে শোক করতে নেই।
_তাহলে তুমি ছাড়বে না...।


দুই.

এই মুহূর্তে ক্ষীণ এক চুড়ির আওয়াজে আমি স্মৃতির জলা থেকে উঠে আসি। তারপর বালিশ থেকে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকাতে সন্ধ্যামণিকে দেখতে পাই। সে দুই হাত বাড়িয়ে খোলা পাল্লার দুদিকে ধরে খানিকটা বাঁকা হয়ে ঠিক যেন অপর্ণার মতো মৃদু মৃদু দোল খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ভেতর কী যেন একটা ছলাৎ করে লাফিয়ে ওঠে। আমার দম বন্ধ লাগে। শরীরে অবশ-অবশ একটা ঝিনঝিনে স্রোত বয়ে যায়। তার সব কিছুই যেন অপর্ণাকে ছাড়িয়ে!
সে এককালে যাত্রাদলের গাইয়ে-নাচিয়ে ছিল। টোটকা বিক্রেতা ছনম পোদ্দার তার নাচ-গান শুনে এমনই মুগ্ধ হয়েছিল যে সে তার শেষ সম্বল পৈতৃক ভিটামাটি বিক্রি করে যাত্রাদলের প্রধানের কাছ থেকে তাকে একরকম কিনে নিয়ে বিয়ে করেছে। মাস পাঁচেক আগে তারা আমাদের এই প্রাচীন বাড়ির নিচের দুটো পরিত্যক্ত ঘর ভাড়া নিয়েছে।

সে ফোঁড়ন কাটল_কী ব্যাপার, কার কথা ভাবছ যে এমন দিনেও ঘুমাতে পারছ না?
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আড়মোড়া ভাঙি_কার কথা আর ভাবব। সামনে পরীক্ষা। কিন্তু পড়াশোনার কিছুই হচ্ছে না।

সন্ধ্যামণি ভেতরে এগিয়ে এসে আমার বিছানার পাশে বসতে বসতে বেশ আক্ষেপের গলায় বলে_ও তাই। আমি ভাবলাম কে না কে আবার তোমার মন চুরি করতে ঢুকেছে। এই বয়সটা তো ভালো না গো, বুঝলে। কলেজে পড়ে কত ছেলেমেয়ে সেখানে।_তো যাকগে, জানো, আমার আঁচলগুলো আজ ভিজে যাবে। এই দুঃখে আবার বুকটা ফেটে যেতে চাচ্ছে! বলেই সে গভীর একটা শ্বাস ফেলে এবং টেনে তার ভরাট-ভয়ানক বুকটার ফেটে যাওয়াটা রোধ করতে যেন একটা হাতে ঠেসে ধরে।
এমন দৃশ্যে আমার বুক চিড়ে খরখরে এক অমসৃণ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে_ছাদে দিয়েছেন, তাহলে দেরি করছেন কেন, যান, তুলে ফেলেন। বৃষ্টি তো এখনো শুরু হয়নি!

ঠোঁট উল্টে মাথা দোলায় সন্ধ্যামণি_উঁহু, সেটা সম্ভব নয়। তোমার দাদা, যাওয়ার আগে সিঁড়িঘরের চাবিটা নিয়ে গেছে!
_কেন, সিঁড়িঘরের চাবি নিয়ে গেছে কেন?
এ কয় দিনে বেশ বুঝতে পেরেছি, টোটকা বিক্রেতা লোকটা ভীষণ খিটমিটে স্বভাবের। ভূতের মতো তার লম্বা শরীরটা শুকনো, আমচুরের মতো। শুধু যেন হাড় আর কুঁকড়ে যাওয়া চামড়া। বলা বাহুল্য, তার বয়সটা অবশ্যই সন্ধ্যামণির চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। সন্ধ্যামণির পাশে তাকে অথর্ব কোনো পুরোহিতের মতো লাগে। সন্ধ্যামণিকে দেখায় নিটোল এক উদ্ভিন্নযৌবনা দেবীর মতো সুন্দর। আমি আড়চোখে প্রায়ই তাকে দেখি। তার গলাটাও ভারি মিষ্টি।

_ও একটা সন্দেহবাতিক মানুষ। আমাকে সন্দেহ করে। মনে করে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে_হি হি। সে হাসতে হাসতে আমার গায়ে ভেঙে পড়ে।
আমি তার স্পর্শভারে কেমন যেন তড়িতাহতের মতো কেঁপে উঠি। অতঃপর নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে মাথা ঘুরিয়ে খোলা জানালার দিকে তাকাই।
_ভালোই হলো! সন্ধ্যামণির গলায় যেন খুশির আমেজ_এসো, এ রকম বাদলা দিনে বসে বসে গল্প করি।

আমি অবশ পায়ে বিছানায় ফিরে আসতে আসতে টের পাই, অসম্ভব জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। এ হারে ঘণ্টাখানেক হলেই এলাকার রাস্তাঘাট সব তলিয়ে যাবে। লোকজনের ঘরে ফেরা অসম্ভব হয়ে উঠবে। অতঃপর আমি সন্ধ্যামণির মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করি_ছনমদা, ফিরবে কখন?

আমার গলার স্বরটা কাঁসারিকম্পিত ধাতবধ্বনির মতো শোনায়। হয়তো এ কারণে সন্ধ্যামণি যেন আমার জখম অবস্থাটা জরিপ করতে আমার মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকে। তারপর এমন ভীষণ এক অভিমানী কণ্ঠে বলে : যেন শুঁটকো লোকটার জন্য তার মনপ্রাণ ফেটে যাচ্ছে।
_কখন নয়, বরং বলো কবে? মাসের মধ্যে এখন তার কুড়ি দিন বাইরে না থাকলে চলে না। সুখে খেতে ভূতে কিলায়, জানো না!

_কেন, কী হয়েছে?
_হবে আর কী? ওই যে বললাম, সুখে খেতে ভূতে কিলায়! অথচ মিথ্যা করে বলে, এ শহরে নাকি আগের মতো ওষুধ কেনার আর কোনো লোক নেই। সে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বলতে থাকে_এই বিয়ের পর যেদিন শুনেছে, আমার আর ছেলেপুলে হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেই থেকেই তার এই ঘরবিবাগী রোগ। আমি কতবার তাকে বলেছি, যদি এতই তোমার ছেলেপুলের শখ থাকে, তাহলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা বিয়ে করো গা। তারপর সেই মেয়েটার পেটে তোমার বাচ্চা রুয়ে দাও। কিন্তু না, তার এক কথা। সে আমাকে ছাড়বেও না, আবার আমার কাছেও থাকবে না। এটা কেমন কথা, তুমিই বলো? আমি তো একটা মানুষ। শরীর বলে তো আমারও একটা ব্যাপার আছে। নাকি নেই। আর ছেলেপুলে যে হবে না, সেটা তো তোমার দোষে। কারণ প্রথমবার আমাকে অমন হাতুড়ে পদ্ধতিতে খালাস করালে কেন, বাপু। রেখে দিলেই পারতে।

_কেন, এ রকম করতে হলো কেন?
_কেন আবার! ওই যে বললাম না, ওর সন্দেহবাতিক আছে। সে বলল, আমার পেটে যে এসেছে, সেটা নাকি তার না। এ নিয়ে তুমুল একটা কাণ্ড বেধে যায়। আমি শেষ পর্যন্ত ওকে বিশ্বাস করাতে না পেরে বিষ খেতে গিয়েছিলাম। ইঁদুর মারা বিষ।

_তারপর!
_তারপর আর কী। শেষমেশ ওর জোরাজুরিতে ডিএনসি করাতে রাজি হলাম। তারপর থেকে আমি বাঁজা!

সন্ধ্যামণির এই কথায় কী বলা উচিত বা কী সান্ত্বনা দেওয়া যায় এটা ভাবতেই আমরা উভয়েই দারুণভাবে চমকে ওঠি দুধসাদা বিদ্যুৎ ঝলকানিসহ প্রচণ্ড এক বজ্রপাতে। ভয়ানক সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যামণি চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় চিতপাত হয়ে পড়ি।
আমার ওপর সন্ধ্যামণি। এ মুহূর্তে আকাশ আবার চমকায়, আবার বজ্রপাতের আওয়াজ হয়। সন্ধ্যামণির ভীত আলিঙ্গনও আরো ভয়ানক দৃঢ় হয়। তার ও রকম কঠিন বাহু বন্ধনে এবং তার নরম শরীরের ভারে আমি বড় অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যাই। সে আমাকে এভাবে জড়িয়ে না ধরলেও পারত। আমি মুক্ত হওয়ার চেষ্টায় বলি_দম বন্ধ হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি ছাড়ুন!

সন্ধ্যামণি ঠিক ঠিক সেই রাত্রির বনাঞ্চলের হুবহু অপর্ণার মতো করে উচ্চারণ করল_না, ছাড়ব না।
_কেন?
_অঁ-হু... তবে ছাড়তে পারি, এক শর্তে!
_বলুন কী শর্ত? চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে বলে সহসাই আমি যেন থরথর করে কেঁপে ওঠি। বিশেষ করে প্রকৃতি যেমন ভয়ানক ঘনঘোর হয়ে মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরাচ্ছে, তেমনি ভয়ানক ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে, যেন শহরের ভিতসুদ্ধ উপড়ে ফেলবে। উপরন্তু অন্ধকার গ্রাস করেছে আমাদের।
_যদি তুমি আমার এই দুই ঠোঁটে চুমু এঁকে দাও!

বলেই সে আমাকে সম্পূর্ণরূপে পাগলপাড়া করে তুলতে সে রাতের অপর্ণার মতো হুবহু নিজের ঠোঁট দুটো জিভের ডগা দিয়ে চেটে নিয়ে আমাকে তার বাহুডোরে ঝাঁকাতে থাকল_নাও, দাও পারবে না? আর এ রকম ম্যালেরিয়া রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছ কেন? একটু শান্ত হও, ধীরে ধীরে শ্বাস নাও। ভয়ের কিচ্ছু নেই : এটা তোমার নিজেরই নতুন আরেকটা জন্ম। তুমি পুরোদস্তুর এক ব্যাটাছেলে বনে যাবে : যা তুমি কখনোই ছিলে না!

আমি ঘোরলাগা চোখে তার মুখের দিকে তাকাই। ইতিমধ্যে তার চেহারা যথেষ্টেরও বেশি লাবণ্যে ভরে গেছে। নিঃশ্বাসে আগুনের হল্কা : সেই সঙ্গে তার চোখ দুটোয় যেন এক অচেনা জ্যোতির চিকচিক ঝিলিক। এত সব আয়োজনে সত্যি সত্যিই কেন জানি নিজেকে যেন আর আগের সেই আমি বলে মনে হয় না : তাকে যেন খুঁজেও পাওয়া যায় না।
-----
সুত্র: শিলালিপি-কালেরকন্ঠ
২৩ এপ্রিল ২০১০

1 comment:

Mirza Rana said...

অসাধারণ গল্প।