Tuesday, May 25, 2010

দেহের বাইরে - মশিউল আলম

বাতাসে দুলছে লকলকে ঘাসের ডগা। সে-ডগায় বসার চেষ্টা করছে একটি প্রজাপতি, কিন্তু পারছে না। একটি হাত এগিয়ে এল প্রজাপতিটির দিকে। লম্বা, ফরসা, সুন্দর পাঁচটি আঙুল।

টেলিলেন্স লাগানো ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ সরিয়ে নিল নয়ন। দেখতে পেল বেশ দূরে এক তরুণী, তার পাশে এক তরুণ। তারা নয়নের দিকে চেয়ে চোখমুখ ভরে হাসছে, হাত ধরাধরি করে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। নয়ন অবাক চোখে চেয়ে রইল। ওরা কাছে এগিয়ে এল: দুজনেই ভীষণ অচেনা, ইহজীবনে কখনো কোথাও ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ে না নয়নের।
তাহলে এভাবে নির্লজ্জের মতো হাসতে হাসতে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসার কী মানে হয়? মনে মনে বলল নয়ন। এবং দেখল যে সত্যিই কথা বলে উঠল ওদের একজন, তারই উদ্দেশে: ‘আমাদের একটা ছবি তুলে দিবেন, প্লিজ?’ এ-কথা বলল মেয়েটি, যে এত সুন্দর যে তার পাশে ওই তরুণটি না থাকলে নয়নের নিজেকে মনে হতো জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ। মেয়েটির অনুরোধে নয়ন সাড়া দেওয়ার আগেই ‘প্লিজ, একটা’ বলে উঠল মেয়েটির এক হাত ধরে-থাকা তরুণটি, যে দেখতে এমনই বদখত যে অত সুন্দর মেয়েটির হাত ধরে আছে বলে ওর গালে কষে এক চড় মারতে পারলে নয়নের খুব সুখ হতো।




‘তোলেন না, প্লিজ! তাহলে আমরা আর আপনাকে ডিস্টার্ব করব না।’ আকুল কণ্ঠে বলল সুন্দর মেয়েটি। নয়ন কিছু বলল না। আবার বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখটা রাখল ক্যামেরা ভিউ ফাইন্ডারে। ছেলেমেয়ে দুটি এবার হাসিতে ঝলমল করে উঠল, পরস্পরের কাঁধে কাঁধ চেপে দাঁড়াল খুব ঘনিষ্ঠভাবে। আরও ঘনিষ্ঠ দেখানোর মতলবে ছেলেটি তার ডান হাতে বেড় দিয়ে ধরল মেয়েটির পাতলা কোমর। নয়নের মেজাজ একদমই খিঁচড়ে গেল। সে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে ওদের ছবি ঝাপসা দেখতে লাগল। লম্বা লেন্সটি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ফোকাস ঠিক করার চেষ্টা করল, কিন্তু ওদের ছবি কিছুতেই স্পষ্ট হলো না। নয়ন অবাক আর খানিক বিভ্রান্ত হয়ে ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল ছেলেমেয়ে দুটির দিকে। দেখল, ওরা দিব্যি হাসছে, চোখেমুখে আকুল অনুরোধের ভাব। নয়ন আবার ফোকাস পরিষ্কার করার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই ফল হয় না, সে চোখ রগড়ায়, তাই দেখে ছেলেমেয়ে দুটি এবার অন্য রকম করে হাসে। মেয়েটির তির্যক কণ্ঠ ছুটে আসে নয়নের দিকে:
‘কী ব্যাপার? ক্যামেরাই নষ্ট হয়ে গেল?’
নয়ন স্বপ্ন দেখছিল, ঘুম ছুটে গেল। যাবেই, কেননা নয়নের বয়স চব্বিশ, আর ওই তরুণী ছিল অসম্ভব সুন্দর। এমন সুন্দর নারীর দেখা মেলে কেবল স্বপ্নেই, এবং কেবলই নবীন যৌবনে।

ঘুম ভাঙার পরে নয়নের বেশ অবাক অবস্থা হলো: কে এই মেয়ে? কাকে আমি স্বপ্নে দেখলাম? এই রকম জিজ্ঞাসা নিয়ে শুয়ে শুয়ে খেলা করল কিছুক্ষণ। ওর মনে এল নীলু, ওর খুব ঘনিষ্ঠ মেয়ে-বন্ধু। কিন্তু নীলু কি এত সুন্দর? আর কেনই-বা সে স্বপ্নের মধ্যে অন্য এক মেয়ের রূপ ধরে হাজির হবে তার সামনে, তাও অন্য এক ছেলের হাত ধরে, যে কিনা দেখতে বড়ই বদখত!


এই পর্যন্ত ভেবেছিল নয়ন, ঘুম ভাঙার পর। এরপর আর মাত্র ঘণ্টাখানেক তার মনে ছিল ওই স্বপ্নের অনুরণন। ভার্সিটি যাওয়ার পরে, বন্ধুদের আড্ডায় নানা গল্প-গুজবে, আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে দেখা ও কথা হওয়ায়, এবং নীলু ছাড়াও আরেকটি পরিচিতি মেয়ের সঙ্গে (যে নীলুর চেয়ে বেশি চোখা) অন্তরঙ্গ ভাব-বিনিময় ইত্যাদির মিথস্ক্রিয়ায় সে ভুলে গিয়েছিল সকালের স্বপ্ন বা সেই স্বপ্নে দেখা মেয়েটির কথা।

কিন্তু গভীর রাতে ফিরে আসে সেই মেয়ে। এবার স্বপ্নে নয়, ভারচুয়াল জগতে, যার সঙ্গে বাস্তব জগতের যোগ থাকে বলে ধারণা করা হয়।
রাত সাড়ে এগারোটায় নয়ন প্রবেশ করে ভারচুয়াল জগতে। উন্মোচন করে তার প্রিয় ‘ফেইসবুক’। বন্ধুদের মেসেজগুলো পড়ে, কোনোটার উত্তর দেয়, কোনোটার দেয় না। অন্য বন্ধুদের ফ্রেন্ডলিস্ট দেখে, এই মুহূর্তে কে কে ভারচুয়াল তথ্যমহাসড়কে আছে, ওয়ালে ওয়ালে কে কী লিখেছে ইত্যাদি দেখে। তারপর দেখে নিজের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের তালিকা: ৭৮ জন নারী-পুরুষ তার বন্ধুতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অনুরোধ পাঠিয়েছে। সে-তালিকার প্রথম ব্যক্তির ছবিটি দেখেই নয়ন সশব্দে তাজ্জব বনে যায়; যেন ঠাস করে একটা শব্দ হয় তার করোটির ভিতরে: সকালে স্বপ্নে যে-মেয়েটিকে সে দেখেছিল সেই মেয়েটির ছবি। মেয়েদের মতো ডাগর নয়ন দুটি বড় বড় করে ছবিটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নয়ন; যেন সংবিত্ হারিয়ে ফেলেছে। তারপর, যখন তার সংবিত্ ফিরে আসে, তখন সে মেয়েটির প্রোফাইল ওপেন করে। কিন্তু বন্ধুর তালিকাভুক্ত নয় বলে নয়ন মেয়েটির প্রোফাইল থেকে তার সম্পর্কে কোনো তথ্যই প্রায় জানতে পারে না। তাই সে প্রথমেই মেয়েটির ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে, ‘কনফার্ম’ অপশনে ক্লিক করে; সেই সঙ্গে তার উদ্দেশে এই মেসেজটি পাঠায় ঠিক এইভাবে: who r u?

রাত তিনটা পর্যন্ত নয়ন ভারচুয়াল তথ্যমহাসড়কের অলিগলি ঘুরে বেড়ায়। তারপর উত্তেজিত স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে শুয়ে পড়ে, ভোর পর্যন্ত তার চোখে ঘুম আসে না। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে বলতে পারে না, যখন ঘুম ভাঙে তখন বেলা ১১টা। তখনই সে আবার ইন্টারনেট খুলে ফেইসবুকে ঢোকে, কিন্তু তার সেই মেসেজটির কোনো উত্তর আসেনি। বেলা দেড়টায় সে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পৌঁছে, কিন্তু ক্লাসে যায় না, ক্যান্টিনে বসে কড়া ব্ল্যাক কফি খেতে খেতে চিন্তা করে সেই মেয়েটির কথা, তাকে পাঠানো মেসেজটির উত্তরের কথা: কোনো উত্তর আসবে তো?

রাতে সে আবার ফেইসবুকে ঢোকে এবং সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে যায়: i am i, nobody else.
নয়নের হূত্কম্প শুরু হয়ে যায়। কাঁপা আঙুলে সে মেসেজের উত্তরে লেখে: may i know your mobile number, please?

সে মেসেজটি সেন্ড করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।
একটু পরেই চলে আসে উত্তর: but why?
নয়ন লিখল: do you really exist?

মেসেজটি সেন্ড করে সে উদ্গ্রীব হয়ে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইল।
একটু পরেই উত্তর এল: maney?
নয়ন লিখল: apni ki sotti sotti achhen?
একটু পরে উত্তর এল: tar maney ki?

নয়ন এবার ভাবতে লাগল, কী লিখলে মেয়েটিকে বোঝানো যাবে যে সে জানতে চাচ্ছে মেয়েটির অস্তিত্ব আসলেই বাস্তব কি না, বাস্তবে সে আছে কি না।
মনে মনে সে একটা বাক্য সাজাল। তারপর লিখল: if u really exist, please send me your mobile number. i seriously need to talk to you.
কিন্তু আর কোনো উত্তর এল না। সময় গড়িয়ে চলল, চলল। চারদিকে ভীষণ নৈঃশব্দ নেমে এল। শুধু ধক ধক করে চলল নয়নের হৃৎপিণ্ডটা।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল নয়ন জানে না। সে চেয়ার থেকে উঠে ঘরময় পায়চারি করে রাত ভোর করে দিল। ভোরে আজানের শব্দে তার সংবিত্ ফিরে আসে। সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তাকায়। বাইরে নির্জন রাস্তা। সতেজ নির্মল বাতাস আসে। তার ঘুম ঘুম লাগে।

দুপুর বারোটায় ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার কম্পিউটারের সামনে বসে, ফেইসবুকে প্রবেশ করে। তার সেই মেসেজের উত্তর চলে এসেছে। মেয়েটি তার মোবাইল নাম্বারটি লিখে পাঠিয়েছে: ০১৭১৩...
সঙ্গে সঙ্গে সে ওই নাম্বারে কল করে। নয়ন শুনতে পায় মেয়েকণ্ঠে গান: ‘নয়ন ভাসিল জলে..।’

নয়ন একটু অবাক। তারপর একটি মেয়ের কণ্ঠ, ‘হ্যালো।’
‘এটা আমি, ফেইসবুকে আপনার নাম্বার চেয়েছিলাম...।’
মেয়েটি বলে, ‘বুঝতে পারছি। বলেন।’

‘আমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে আপনাকে বলি... ফেইসবুকে আপনি যে ছবিটা দিয়েছেন, ওটা কি আপনার নিজের ছবি?’ অবিশ্বাসী কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে নয়ন।
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা... আমার সঙ্গে আপনার, বা আপনার সঙ্গে আমার কি কখনো দেখা হয়েছিল?’
‘মনে হয় না।’
‘ধরেন, কোনো মার্কেটে, বা ভার্সিটি এলাকায়, বা অন্য কোনো পাবলিক প্লেসে?’
‘না।’

নয়ন থামে। মেয়েটির কথাগুলো কোমল, মিষ্টি শোনায় না। বরং রাগী, একটু বিরক্ত বলে মনে হয়। নয়ন একটুক্ষণ চিন্তা করে। তারপর একটা ঢোক গেলে, মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে আবার কথা শুরু করে।
‘কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। এটা একটা কিউরিয়াস ব্যাপার।’
‘মানে কী?’
‘আমি একদিন একটা মেয়েকে স্বপ্নে দেখলাম। তাকে আগে কখনো দেখিনি। তাকে চিনি না। তারপর ফেইসবুকে আপনার ছবিটা দেখে চমকে উঠলাম, এটা তো সেই মেয়েই!’
‘আপনার দেখার ভুল হতে পারে।’
‘দেখার ভুল! এ রকম দেখার ভুল হওয়া কি রিয়েলি সম্ভব?’
‘নিশ্চয়ই সম্ভব। না-হলে দেখার ভুল কথাটার অস্তিত্ব থাকত না।’
‘আপনি কী করেন?’
মেয়েটি এবার বলে, বেশ গম্ভীর কণ্ঠে: ‘আমার মনে হয়, আপনার যা জানার ছিল সেটা হয়ে গেছে। এখন রাখি?’
নয়ন অসহায় কণ্ঠে বলে, ‘রাখবেন?’
‘হুঁ। সেটাই ভালো হবে।’

পরদিন নয়ন ফেইসবুক খুলে দেখতে পায়, মেয়েটির প্রোফাইল পিকচারের জায়গাটি ফাঁকা। সে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির মোবাইল নাম্বারে কল করে। কিন্তু মেয়েটির কণ্ঠ শুনতে পায় না, তার বদলে শুনতে পায় অন্য একটি মেয়ের কণ্ঠ: ‘এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

নয়নের বুঝতে কষ্ট হয় না যে মেয়েটি তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু সে ক্রমাগত ফোন করে চলে। এভাবে তিন দিনের মাথায় সে পৌঁছুতে পারে মেয়েটির কাছে:
‘হ্যালো।’
‘ফেইসবুক থেকে আপনার প্রোফাইল পিকচারটা রিমুভ করেছেন কেন?’
‘আর ভালো লাগে না।’
‘তাহলে অন্য আরেকটা ছবি দিলেই পারেন।’
‘আপনি আমার কাছে কী চান?’

হকচকিয়ে যায় নয়ন; মেয়েটির কণ্ঠ আগে কখনো এমন কর্কশ শোনায়নি। নয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ‘আপনি তো আপনার প্রোফাইল ইনফোতে লিখেছেন আপনি ইন্টারেস্টেড ইন ফ্রেন্ডশিপ। আমিও ফ্রেন্ডশিপেই ইন্টারেস্টেড।’
মেয়েটি বলে যে, সেটা ফেইসবুকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই ভালো হয়।
‘কেন?’
‘আমার জগত্টা ভারচুয়াল। ফিজিক্যালি আমি আমি না।’
‘মানে?’
‘মনে করেন, আমি ফিজিক্যালি এক্সিস্ট করি না।’
‘এইটা আবার কেমন কথা?’
‘খুবই সহজ। মনে করেন আমি শুধু ফেইসবুকেই আছি, বাস্তবে আমার কোনো অস্তিত্ব নাই।’
‘কিন্তু আসলে তো আপনি আছেন। কেন মনে করব আপনার কোনো অস্তিত্ব নাই?’

মেয়েটির কণ্ঠ এবার যেন হুঁশিয়ারির মতো শোনায়: ‘আপনার ভালোর জন্যই বলছি। আমার ফিজিক্যাল এক্সিস্টেন্স নিয়ে ইন্টারেস্টেড হবেন না।’
‘কিন্তু কেন?’
‘আমার ছবি আপনার ভালো লেগেছে। এখন ফোনে কথা বলছেন, দুই দিন পর দেখা করতে চাইবেন।’
‘চাইলে কোনো প্রবলেম আছে?’
‘আছে। বেশ প্রবলেম।’
‘শুরু থেকেই দেখছি, আপনি রহস্য করতে ভালোবাসেন।’
‘আমি কোনো রহস্য করছি না।’
নয়ন ফট করে বলে, ‘আমি আপনাকে সামনাসামনি দেখতে চাই।’
‘সেটা ভালো হবে না।’
‘কেন?’
‘ভালো হয়, আপনি যদি শুধু ফেইসবুকের মধ্যেই যোগাযোগটা সীমাবদ্ধ রাখেন।’
‘কিন্তু কেন?’
‘আপনি আমার কাছে এলে শক্ড হবেন। তারপর নিঃশ্বাস বন্ধ করে পালাবেন। সেটা আমার খারাপ লাগবে।’
‘কী বলছেন এসব? কেন শক্ড হব? কেন পালাব?’
মেয়েটি লাইন কেটে দেয়। নয়ন কয়েকবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করে। তারপর মোবাইল সেটটা ছুড়ে ফেলে দেয় বিছানায়।

কয়েক দিনের মধ্যে নয়নের অবস্থা বড়ই সঙ্গিন হয়ে ওঠে। সাধারণ বন্ধুবান্ধব দূরে থাক, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মেয়েবন্ধুটির সঙ্গেও সে আর দেখা করে না, এমনকি তার ফোনকলও রিসিভ করে না। ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। সে তাকে কল করে বলে, ‘আপনার কি মনে হচ্ছে না, এখন আমাদের একবার দেখা হওয়া উচিত?’
মেয়েটি শক্ত কণ্ঠে বলে দেয়, ‘না।’

‘কেন এমন করছেন? আপনি তো জানেন, আমাদের দেখা হবেই।’
‘সেটা জানি,’ সবজান্তার মতো বলে মেয়েটি, ‘তারপর কী হবে তাও জানি। কিন্তু ভালো হবে না।’
‘খুব ভালো হবে। আপনার ছবি দেখার আগেই আমি আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি; বুঝতে পারছেন এটা কেমন যোগাযোগ?’
‘আপনার দেখা ভুল। আমার সঙ্গে দেখা হলে আপনার সব ভুল ধারণা ভেঙে যাবে।’
‘ঠিক আছে, যাবে। সেই জন্যই কি আমাদের দেখা হওয়া উচিত না?’
‘আমি আপনাকে আবারও নিষেধ করছি।’
‘আমি আপনার এই নিষেধটা শুনব না।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে আপনি এসে আমাকে দেখে যান।’
‘কোথায় আসব?’
‘আমাদের বাসায়।’
নয়ন আমতা আমতা করে, ‘বাসায়! অন্য কোনোখানে দেখা করা যায় না?’
মেয়েটি দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দেয়, ‘না।’
‘কেন? বাইরে কী প্রবলেম?’
‘বাসায় আসতে আপনার কী প্রবলেম?’
‘না, কোনো প্রবলেম নাই। কিন্তু বাইরে কোথাও হলেই বেটার হয়।’
‘সম্ভব না। আপনি আসতে চাইলে আমাদের বাসার অ্যাড্রেসটা লিখে নিতে পারেন।’
মেয়েটি তাদের বাসার ঠিকানা বলে, নয়ন তা লিখে নেয়।

পরদিন বেলা ১১টায় নয়ন এক তোড়া ফুল নিয়ে হাজির হয় মেয়েটির বাসায়। বুয়া দরজা খুলে দিয়ে তাকে বসতে বলে। নীরব নির্জন ঠান্ডা ও আবছা আঁধার ড্রয়িংরুমে একটি বেতের সোফার এক কোণে ফুলের তোড়া হাতে বসে থাকে নয়ন। দূর থেকে একটি মেয়ের কণ্ঠে ভেসে আসে সেই গান: ‘নয়ন ভাসিল জলে...।’
অনেকক্ষণ এভাবে কাটে। গান ফুরোলে নিঃশব্দে এগিয়ে আসে একটি হুইলচেয়ার, তাতে বসা মেয়েটিকে দেখে নয়নের হাত থেকে আস্তে পড়ে গেল ফুলের তোড়াটি। প্রশান্ত হাসি মুখে নিয়ে এগিয়ে এল মেয়েটি। স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটিই! ফেইসবুকের ছবিতে দেখা সেই মেয়েটিই!

নয়নের মুখে কোনো কথা নেই, তার ডাগর নয়ন দুটি এখন বিস্ফারিত।
প্রশান্ত হাসিভরা মুখের মেয়েটি বলে, ‘আমি যদি আপনাকে বলতাম, নয় মাস বয়সে আমার পোলিও হয়েছিল, বিশ্বাস করতেন না। বলতেন, আমি আপনাকে দেখা দিতে চাই না বলে মিথ্যা বলছি...। আমি জানতাম, আমাকে না দেখে আপনি ছাড়বেন না...।’ মেয়েটি থামে, এমন দৃষ্টিতে নয়নের দিকে তাকায় যেন নয়নের সমস্ত কিছু সে জানে, ‘এখনই চলে যাবেন? এক কাপ চা খেয়ে গেলে খুশি হতাম...।’

নয়নের মুখে কোনো কথা নেই। বুয়া চা-বিস্কিট রেখে যায়। নয়ন চায়ের কাপে দুটো চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পায়ের কাছে পড়ে থাকা ফুলের তোড়াটির ওপর এবার তার চোখ পড়ে। সেটি তুলে নিয়ে সে মেয়েটির দিকে এগিয়ে ধরে। মেয়েটি স্মিত হেসে তা গ্রহণ করে: ‘অনেক ধন্যবাদ।’

নয়ন কিছু বলতে পারে না। দরজার দিকে তাকায়।
‘সাবধানে যাবেন,’ মেয়েটি বলে, ‘এর আগে যারা আমাকে দেখতে এসেছে, তারা প্রত্যেকেই ফিরে গিয়ে সিক হয়ে পড়েছিল। একজন তো অ্যাকসিডেন্ট করেছিল..., কেয়ারফুলি যাবেন।’

রুদ্ধশ্বাসে ফিরে চলে নয়ন, অকারণে ঘন ঘন হর্ন বাজাতে বাজাতে। তার বুকের ভেতরে বুঝি চিত্কার চলছে, ‘পালাও পালাও!’
দূরের ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ বাতি হলুদ হলো, তারপর লাল। নয়নের সামনের গাড়িগুলো থেমে গেল। নয়ন ব্রেক কষবে, কিন্তু হঠাত্ সে দেখল, পা দুটো তার হুকুম শুনছে না, দুটোই সম্পূর্ণ অবশ।
প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল আকাশ। তীরের বেগে ছুটে বেরিয়ে এল নয়ন। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, তার গাড়িটা প্রবল বেগে ধাক্কা খেল সামনের টয়োটা প্রিমিওর সঙ্গে। চিত্কার ভেসে এল, ‘ওই শুয়ারের বাচ্চা!’ প্রিমিওর মালিক চিত্কার করতে করতে এগিয়ে এল নয়নের গাড়ির দিকে, নয়নের গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল সে: চোখে দ্যাখেন না নাকি?

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নয়ন দেখতে পাচ্ছে, ড্রাইভিং সিটে তার শরীর, স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে ঠুকে আছে কপাল, থুতনি চুইয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। চারদিক থেকে ছুটে আসতে লাগল অনেক মানুষ।
‘ফিট হইছে! মাথায় লাগছে! জ্ঞান হারাইছে!’
‘মারা যায়নি ত?’
লোকজন গাড়ির দরজা খুলে ধরাধরি করে বের করে আনে নয়নের দেহটি।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে থাকে নয়ন। দূর থেকে একটি মেয়ের কণ্ঠে ভেসে আসে গান: ‘নয়ন ভাসিল জলে...।’

ঢাকা, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯
------------

সূত্র: প্রথম আলো সাহিত্যসাময়িকী: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯

No comments: