Friday, May 28, 2010

বিন্দু - মূল : খুশবন্ত সিং - রূপান্তর: মোবারক হোসেন খান


দলীপ সিং খাটিয়াতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। বেশ গরম পড়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার লেশমাত্র নেই। কোমরে এক টুকরো কাপড় ছাড়া তার সারা গা উদাম। তবুও গা থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে। সারাদিনের রোদে উত্তপ্ত মাটির দেয়াল ফুঁড়ে যেন গরম বের হয়ে আসছিল। ঘরটাকে ঠাণ্ডা করার জন্য ছাদে জল ছিটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। বরং ভ্যাপসা গরমটা যেন আরো বেড়ে গেছে। আর দেয়াল থেকে মাটি আর গোবরের একটা বিদঘুটে গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। পেট ভরে জল খেয়েও মনে হচ্ছে যেন গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওদিকে মশার উপদ্রব তো আছেই। কানের কাছে একটানা গুনগুন গান গাইছে। মশার গুনগুনানি তার কানের কাছে এলেই সে হাতের তালু দিয়ে চাপড় মেরে চ্যাপ্টা করে দিচ্ছিল। দুএকটা মশা কানের ফুটো দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছিল। সে তখন কানের তেলতেলে ফুটোতে আঙুল দিয়ে চেপে মেরে ফেলছিল। গালে কামড়াতে গিয়ে মশা তার দাড়ির ভেতর আটকে যাচ্ছিল। মশার কামড়ে তার সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল।

তার ঘরের পাশেই একটা সরু গলি। গলির সরু রাস্তার ওপাশে তার চাচার বাড়ি। দলীপ সিং চাচার বাড়ির ছাদে একসারি খাটিয়া দেখতে পাচ্ছিল। একটা খাটিয়ার ওপর তার চাচা বান্তা সিং হাত-পা ছড়িয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তার উদাম পেটটা ওঠা-নামা করছিল, বিকেল বেলা ভাং খেয়ে এখন মরার মতো ঘুমাচ্ছে। পাশের অন্য খাটিয়াগুলোতে শুয়ে বসে বাড়ির মেয়েছেলেরা পাখার বাতাস করছিল আর মৃদ্যু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।




দলীপ আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল। তার চোখে ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই। অথচ অন্য পাশে ছাদের ওপর তার চাচা, তার বাবার ভাই খুনিটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! ও বাড়ির মেয়েছেলেরা বসে গল্প-গুজব করার ফুরসত পাচ্ছে, আর তার মাকে ছাই দিয়ে বাসন মেজে ঘুটে তৈরি করার জন্য গোবর কুড়িয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বান্তা সিংয়ের জমিজমা চাষ করার জন্য মজুর আছে। কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। অফুরন্ত সময় তাঁর। ভাং খেয়ে আর ঘুমিয়ে তার সময় কাটে। তার কৃষ্ণনয়না আদরে কন্যা বিন্দুরও কোনো কাজকর্ম নেই। সারা দিন মানুষকে জাপানি সিল্কের পোশাক দেখিয়ে বেড়ানোই তার কাজ। আর এদিকে দলীপ সিংকে কিনা সারা দিন শুধু কাজ করে মরতে হয়।

কীকার গাছের পাতাগুলো বাতাসে নড়ে উঠলো। ছাদের ওপর দিয়ে মৃদু-মন্দ বাতাস বইতে লাগলো। বাতাসের ধাক্কায় মশার দল চলে গেলো। দলীপ সিংয়ের ঘাম শুকিয়ে গেলো। শরীরটাও জুড়িয়ে গেলো। মনের শান্তিটাও ফিরে এলো। চোখের পাতাগুলো ঘুমে ভারী হয়ে এলো। বান্তা সিংয়ের ছাদে মেয়ের দল হাতের পাখা নামিয়ে রাখলো। বিন্দু তার খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে মাথাটা পেছন দিকে বাঁকিয়ে বুক ভরে একরাশ শীতল বাতাস টেনে নিলো। দলীপ চোখ ঘুরিয়ে বিন্দুর দিকে তাকালো বিন্দু ছাদের ওপর পায়চারি করছিল। দলীপ বিন্দুর পায়চারি করা দেখতে লাগলো। খানিক পরে দলীপ পড়শীদের ছাদ আর উঠোনের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবাই ঘুমাচ্ছে। কেউ নড়ছে না। গভীর ঘুমে সবাই অচেতন। বিন্দু পায়চারি থামিয়ে তার খাটিয়ার পাশে দাঁড়ালো। দলীপ সিং বিন্দুকে দেখতে লাগলো। বিন্দু হঠাৎ নুয়ে তার হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত ঘাঘড়ার দুকোন দুহাতে ধরে তার মুখের কাছে তুলে ধরলো। ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত উদাম হয়ে গেলো। একরাম বাতাস তার উদোম করা চ্যাপ্টা পেট আর ভরা নিতম্বে শীতল পরশ শুয়ে পড়লো। খাটিয়ার গুহাতে যেন বিন্দু অদৃশ্য হয়ে গেলো।

দলীপ সিংয়ের চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেলো। তার হৃৎপিণ্ডটা উন্মত্তের মতো লাফাতে লাগলো। বান্তা সিংয়ের ঘৃণ্য চেহারা তার মন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সে চোখ বুজে জ্যোৎøার আলোতে দেখা বিন্দুর চেহারাটা শুধু মনে করতে চেষ্টা করলো। বিন্দুকে ভোগ করার একটা উদগ্ন কামনা তার মনে ছটফট করতে লাগলো। তন্দ্রার মাঝে বিন্দুর চেহারাটা বারবার ভেসে উঠতে লাগলো। বিন্দুও তাকে পেতে চায়Ñ তার সান্নিধ্য লাভের জন্য আকুল মিনতি জানায়। হ্যাঁ, বিন্দুকে দিয়েই সে বান্তা সিংয়ের ওপর প্রতিশোধ নেবে। তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে। দলীপ সিংয়ের চোখ দুটি বোজা থাকলেও অন্য জগতের এক চিত্র সে দেখতে পাচ্ছিল। সে জগতে বিন্দু বাস করে। বিন্দুর ভালোবাসা তাকে পাগল করে তোলে। সে জগতের বিন্দু নগ্না, লজ্জাহীনা আর সৌন্দর্যের রানী।

কয়েক ঘণ্টা পরে দলীপের মা এসে তাকে কাজে যেতে তাগিদ দিলো। জ্যোৎøা রাতের ঠাণ্ডাতেই কাজ করতে সুবিধা। দলীপ বালিশের তলা থেকে ভাঁজ করা জামাটা তুলে গায়ে দিলো। এক ফাঁকে চোখ তুলে ওপাশের ছাদের দিকে তাকালো। বিন্দু গভীর ঘুমে ডুবে আছে।

দলীপ ষাঁড়ের কাঁধে লাঙল চড়িয়ে ক্ষেতের দিকে রওয়ানা হলো। অন্ধকার গলির জনশূন্য পথ ধরে দলীপ জ্যোৎøালোকিত ক্ষেতের দিকে চললো। তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তার মনে তখনো বিন্দুর চেহারা ভাসছিল।

পুবের আকাশ ধূসর হয়ে এলো। আমের বাগান থেকে কোকিলের ডাক ভেসে আসছিল। কীকার গাছে কাক ডাকছিল।

দলীপ সিং ক্ষেতে লাঙল চালাচ্ছিল। কিন্তু তার মনটা পড়েছিল অন্যখানে। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সে শুধু লাঙলটা ধরে পেছন হাঁটছিল। লাঙলের ফলা এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল। আর মাটির খুব নিচেও যাচ্ছিল না। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই দলীপ কেমন যেন লজ্জা পেলো। দিবা স্বপ্ন থেকে নিজেকে মুক্ত করে কাজে মনোনিবেশ করলো। লাঙলটা জোরে চেপে ধরতেই ফলাটা নিচে ঢুকে গেলো। হাতের পাচনটা দিয়ে ষাঁড়ের গায়ে জোরে খোঁচা মারলো। খোঁচা খেয়ে ষাঁড় দুটোও সচল হয়ে উঠলো। ঘোৎ ঘোৎ করে লেজ নাড়তে লাগলো। লাঙলের ফলার আঘাতে মাটির দলা দলীপের পায়ের দুপাশে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। দলীপ আরো জোরে লাঙল চালাতে লাগলো। তার মনের বন্য কামনাটা যেন লাঙলের ফলার ভেতর দিয়ে তামাটে রঙের উর্বরা মাটিকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলতে লাগলো।

সূর্য মাখার ওপর উঠে এলো। দলীপ চাষ করার কাজ থামিয়ে ষাঁড় দুটোকে নিয়ে একটি পিপুল গাছের নিচে গেলো। ষাঁড়ের ঘাড় থেকে লাঙল খুলে দিলো। সে কয়েক বালতি জল তুলে নিজে øান করলো। ষাঁড়গুলো গা ধুয়ে দিলো। তারপর বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। ষাঁড়গুলোর গা থেকে টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়তে লাগলো।

তার মা অপেক্ষা করছিল। সে ঘরে ঢুকতেই মা তার জন্য গরম গরম রুটি মাখন মাখিয়ে খেতে দিলো। একটা বাটিতে কিছু শাক দিলো। আরেকটা বড় কাঁসার গ াসে দুধ খেতে দিলো। দলীপ খেতে লাগলো। তার মা পাশে বসে পাখার বাতাস দিয়ে মাছি তাড়াতে লাগলো। দলীপ রুটি, শাক আর দুধ খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একটা খাটিয়ার ওপর গা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়লো। তার মা তখনো ছেলের পাশে বসে আস্তে আস্তে পাখার বাতাস দিতে লাগলো।

বিকেল পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে দলীপ সন্ধ্যাবেলা আবার ক্ষেত দেখতে গেলো। আলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় তার চাচার ক্ষেতের দিকে তাকালো। বান্তা সিংয়ের ক্ষেতে মজুর খাটে। তার বাবাকে খুন করায় বান্তা সিং সন্ধ্যাবেলা কখনো ক্ষেতে কাজ করতে আসে না।

দলীপ ক্ষেতের পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কাজ শেষ করে ডোবার জলে ভালো করে হাত-মুখ ধুলো। তারপর জলে পা ডুবিয়ে ডোবার পাড়ে ঘাসের ওপর বসে মার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

সন্ধ্যার সূর্যটা আস্তে আস্তে ক্ষেতগুলোর ওপাশে ডুবে গেলো। আকাশে বাঁকা চাঁদের আশপাশে তারার দল ঝিকমিক করে জ্বলতে লাগলো। গ্রামের কুয়োর পাশে মেয়েরা চিৎকার করে কথা বলছিল। ছেলের দল ছুটোছুটি করে খেলা করছিল। ডোবার পাড়ে বসে দলীপ সব শুনতে পাচ্ছিলো। পাখিরা নীড়ে ফিরে রাতের জন্য আশ্রয় নিলো। কুকুরের চিৎকার থেমে গেলো। এক দল মেয়ে ক্ষেতের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে ঝোপের আড়ালে বসে নিজেদের হালকা করে নিলো। তারপর ডোবার জলে হাত-মুখ ধুয়ে চলে গেলো।

দলীপ সিংয়ের মা একটা কাঠের টোকন এনে ছেলের হাতে দিলো। দলীপে সিংয়ের ক্ষেতে খাল থেকে জল দেওয়ার সময় শুরু হয়ে গেছে। দলীপের মা গরু বাছুরগুলোর পরিচর্যা করতে চলে গেলো। বান্তা সিংয়ের মজুরের দলও চলে গেছে। দলীপ ক্ষেতে জল দেওয়ার কাজে লেগে গেলো। কাজ শেষ করে আবার সে ডোবার পাশে শুয়ে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্রাম থেকে ভেসে আসা শোরগোল শুনতে লাগলো। বান্তা সিংয়ের ক্ষেতের দিক থেকেও মেয়েদের কথাবার্তা তার কানে আসছিল। তারপর সব নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো। জ্যোৎøার আলোতে প াবিত পৃথিবীটা যেন বোঝা হয়ে গেলো।

দলীপ সিং শুয়ে শুয়ে চিন্তা করেছিল। হঠাৎ চিন্তার সূত্রটা ছিঁড়ে গেলো। কাছেই কে যেন জল নাড়ছে। সে চোখ ঘুরিয়ে শব্দের দিকে তাকালো। ডোবার ওপারে একটি মেয়ে পাছার ওপর ভর দিয়ে বসে গা ধুচ্ছে। এক হাতে দু’উরুর ফাঁকে জল ছিটাচ্ছিলো। অন্য হাত দিয়ে উরু ঘসছিল। একটু পরে এক মুঠো মাটি তুলে দুহাতে ঘসে হাত দুটো জলের ভেতর কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলো। কুলকুচা করে মুখ ধুলো। কয়েকবার চোখে-মুখে জল ছিটালো। তারপর সে তার টিলা ঘাঘড়াটা খুলে মাটিতে ফেলে রেখে উঠে দাঁড়ালো। গায়ের জামাটা হাত দিয়ে তুলে নিচু হয়ে মুখ মুছতে লাগলো।

মেয়েটি বিন্দু। দলীপ সিংয়ের ভেতরের সুপ্ত কামনাটা মাখা চাড়া দিয়ে উঠলো। সে এক লাফে উঠে পড়লো। এক দৌড়ে ডোবার ওপাশে ছুটে গেল। মেয়েটি তখনো নুয়ে জামা দিয়ে মুখ মুছছিলো। মেয়েটি পেছন ফিরে দেখবারও ফুরসৎ পেলো না। দলীপ সিং পেছন থেকে মেয়েটির বগলের নিচ দিয়ে দুহাত ঢুকিয়ে তাকে জাপটে ধরলো। মেয়েটি তার দিকে মুখ ঘুরাতেই দলীপ সিং মেয়েটির দুঠোঁটে নিজের দুঠোঁট চেপে ধরলো। মেয়েটি ভয়ে চিৎকার দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু দলীপ সিংয়ের ঠোঁটের চাপে মেয়েটির চিৎকার গলা থেকে বের হতে পারলো না। দলীপ মেয়েটিকে নরম ঘাসের ওপর জোর করে শুইয়ে দিলো। বিন্দু বন্য বিড়ালীর মতো দলীপের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। দুহাতে দলীপের দাড়ি থাকলে ধরে গালে নখ ঢুকিয়ে দিলো। দাঁত দিয়ে তার নাক কামড়ে ধরলো। দলীপের নাক কেটে রক্ত পড়তে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বিন্দু ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তার গায়ের জোর যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। ধস্তাধস্তি ছেড়ে দিয়ে নিথর পুতুলের মতো শুয়ে রইলো। তার বন্ধ চোখের দুকোণ বেয়ে অশ্র“র ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। রাতের পান্ডুর জ্যোৎøার আলোতে বিন্দুকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। দলীপের মন হঠাৎ অনুশোচনায় ভরে উঠলো। সে তো কখনো বিন্দুর মনে আঘাত দিতে চায়নি। সে তার খড়খড়ে শক্ত হাত দিয়ে বিন্দুর কপালে আদর করতে লাগলো। বিন্দুর চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে লাগলো। একটু নুয়ে নিজের নাকটা বিন্দুর নাকের সঙ্গে ঘষতে লাগলো। বিন্দু তার আয়ত কৃষ্ণ নয়ন খুলে দলীপের দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। না, তার সে দৃষ্টিতে কেনো ঘৃণার চিহ্ন নেই, কিংবা ভালোবাসাও নেই। সে দৃষ্টি শুধু ভাবলেশহীন। দলীপ বিন্দুর চোখে ও নাকে মৃদু চুম্বন এঁকে দিলো। বিন্দু কেবল শূন্য দৃষ্টি মেলে দলীপের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার দুচোখ বেয়ে শুধু অশ্র“র ঢল নামতে লাগলো।

বিন্দুর বান্ধবীরা তার নাম ধরে ডাকছিল। তাদের সে ডাকে বিন্দু সাড়া দিলো না। বিন্দুর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তাদের একজন ডোবার কাছে তাকে খুঁজতে এলো। শায়িত বিন্দুর অবস্থা দেখে সে চিৎকার শুরু করে দিলো। দলীপ সিং এক ঝটকায় উঠে পড়লো এবং মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সিংগপুরা গ্রামের পুরুষের দল যেন আদালতে ভেঙে পড়েছিল। দলীপ সিংয়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানি শুনতে এসেছে তারা। আদালত কক্ষ, বারান্দা আর আদালত প্রাঙ্গণ দর্শকের ভিড়ে গম গম করছিল। বারান্দার এক প্রান্তে হাতকরা পড়া দলীপ সিং দুজন পুলিশের মাঝখানে বসে আছে। তার মা ছেলের পাশে বসে তাকে পাখার বাতাস করছে। মার মুখ চাদর দিয়ে ঢাকা। মা কাঁদছিল। আর একটু পরপর নাক ঝারছিল। অন্য প্রান্তে বিন্দুকে ঘিরে তার মা ও গ্রামের কয়েকজন মেয়েছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দুও কাঁদছিল আর নাক ঝারছিল। বান্তা সিং ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ফিসফিস করে পরামর্শ করছিল। গ্রামের লোকেরা হকারদের কাছ থেকে মিঠাই কিনে আর কান পরিষ্কার করে সময় কাটাচ্ছিলো। কেউ কেউ আবার ভেণ্ডারের চারপাশে ঘিরে বসে হাসি ঠাট্টায় মশগুল ছিল।

বান্তা সিং সরকারি উকিলকে সাহায্য করার জন্য অন্য আরেকজন উকিল নিযুক্ত করছিল। সেই উকিল বাদীপক্ষের সাক্ষীদের নিয়ে বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে মহড়া দিতে লাগলো। বিবাদী পক্ষের উকিল কি ধরনের প্রশ্ন করতে পারে সে সম্পর্কে তাদের সতর্ক করে দিচ্ছিল। একটু পরে উকিল বাবু আদালতের আরদালি ও কেরানিকে বান্তা সিংয়ের সঙ্গে পরিচয় করে দিলো এবং তাদের কিছু বখশিশ দিতে বললো। বান্তা সিংয়ের কাছে থেকে সরকারি উকিলের জন্য এক বান্ডিল নোট নিলো। বিচারের প্রতিনিধিদের সন্তুষ্ট করা হলো। দলীপ সিংয়ের উকিল নেই। কোনো সাক্ষীও নেই।

আরদালি আদালত কক্ষের দরজা খুলে উচ্চস্বরে মামলার শুনানির কথা ঘোষণা করলো। সে বান্তা সিং ও তার দলবলকে কক্ষে ঢুকতে দিলো। দলীপ সিং পুলিশ পাহারায় কক্ষে ঢুকলো। আরদালি দলীপ সিংয়ের মাকে ঢুকতে দিলো না। কারণ দলীপ সিংয়ের মা আরদালিকে বখশিস দেয়নি। আদালত কক্ষে নীরবতা ফিরে এলে কেরানি বিবাদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গড়তে শুরু করলো।

দলীপ সিং অপরাধ অস্বীকার করলো। ম্যাজিস্ট্রেট কুমার বাবু তদন্তকারী সাব-ইন্সপেক্টরকে বিন্দুকে হাজির করতে বললেন। বিন্দু চাদরের এক প্রান্ত দিয়ে মুখ ঢেকে সাক্ষির কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালো। তখনো সে নাক টানছিল। ইন্সপেক্টর বিন্দুর বাবার সঙ্গে দলীপ সিংয়ের শত্র“তার কথা তাকে জিজ্ঞেস করলো। রক্ত আর বীর্য মাখা বিন্দুর ঘাঘড়া আদালতে দাখিল করলো। বাদীপক্ষের সাক্ষী-সাবুদ পেশ করা শেষ হলো। বিন্দুর সাক্ষি এবং আলামত থেকে বিবাদীর যে নিশ্চিন্ত শাস্তি হবে তাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না।

আসামিকে তার কোনো জিজ্ঞাসা আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলো। দলীপ সিং হাতকড়া বাঁধা দুটো হাত জোর করে বললো, ‘আমি নির্দোষ, ধর্মাবতার।’

কুমার বাবু অধৈর্য হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘তোমার বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ আর সাক্ষী-সাবুদ দাখিল করা হয়েছে, শুনেছো? এখন বাদিনীকে তোমার কোনো প্রশ্ন করার আছে কিনা বলো। না থাকলে, আমি রায় দেবো।’

‘হে মহামহিম, আমার কোনো উকিল নেই। গ্রামে আমার পক্ষে সাক্ষী দেওয়ার একটা লোকও নেই। আমি গরিব। আমাকে কৃপা করুন। আমি নির্দোষ, নিরপরাধ।’

ম্যাজিস্ট্রেট রেগে গেলেন। তিনি কেরানির দিকে ফিরে তাকালেন। কেরানি বললেন, ‘বাদীর জেরা করার কিছু নেই।’

‘কিন্তু’, দলীপ সিং তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, ‘আমাকে জেলে পাঠাবার আগে, হুজুর, বিন্দুকে জিজ্ঞেস করুন, সে রাজি ছিল কিনা। সে আমাকে চেয়েছিল বলেই আমি তার কাছে গিয়েছিলাম। আমি নির্দোষ, হুজুর।’

কুমার বাবু আবার কেরানির দিকে ফিরে তাকালেন। কেরানি বিন্দুকে লক্ষ্য করে বললো, ‘তুমি কি স্ব ইচ্ছায় বাদীর কাছে গিয়েছিলে? জবাব দাওঃ’

কুমার বাবুও বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জবাব দাও, তুমি বাদীর কাছে কি স্বইচ্ছায় গিয়েছিলে?’

বিন্দু কাঁদতে কাঁদতে নাক টানতে লাগলো। ম্যাজিস্ট্রেট আর শ্রোতা-দর্শকরা অধৈর্য আর বিরক্তি বোধ করলেও নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলো। ‘তুমি কি আপন ইচ্ছায় গিয়েছিলে? জবাব দাও। দেরি করো না। আমার অনেক কাজ আছে।’ ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করলেন।

মুখের ওপর ভাঁজ করা চাদরের তলা থেকে চাপা জড়ানো কণ্ঠে বিন্দু জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ।’

No comments: