Friday, May 28, 2010

পরণকথার পাখি - আবুল বাশার

রাখালভোগায় একটি পাখি। রাখালদের ঠকায় কিংবা ভোগান্তিতে ফেলে বলে লোকে পাখিটার ওই রকম নাম দিয়েছে। কিন্তু রাখালভোগায় শুধু যে রাখালদের ভোগান্তি করে তা তো নয়। সে গেরস্তকে হোড়কো দেয়, ঘরের বউঝিকে পাকে ফেলে মজা পায়। তার রকম-সকম অদ্ভুত। পাখিটা দেখতে অনেকটা বাজপাখি ধরনের। তবে মোটেই সে শিকারি পাখি নয়। ওর বিচার-আচ্চা আলাদা।

রাখালভোগায় তেমন কিছু রূপবান কিংবা রূপসী পাখি না হলেও, ওর ঠকম-ঠাট, কেতা-কায়দাদুরস্ত, মানুষকে মজানোর তার শৈলী আছে, তার চঞ্চলতা আছে, গায়ে-পড়া ভাব আছে, ‘ওরে বউ খেলতে আয়’- এমন একটা বার্তাও সে দেয়, তবে সবই ভঙ্গিমে করে, আড়ে আড়ে। সব জেনেও মানুষ তার ফাঁদে পড়ে।

এক রাখালভোগায় সাত রাখালকে ঘোল খাওয়াতে পারে- এমন জনশ্র“তি লোকালয়ে এলে পাবেন। কিন্তু এ গল্প রাখালকে নিয়ে নয়। আখ্যানটি এক সুন্দরী বউকে নিয়ে।



পাল্লায় পড়ে গেল বউ। বউয়ের নাম কালোসোনা ওরফে ময়না। তার স্বামী মানিকলাল ওরফে লালু একজন রায়ত-ব্যাপারী। আধেক চাষ, আধেক ব্যবসা। গঞ্জে ছোট একটি দোকান খুলে ডিমের আড়তদারি ব্যবসা দিয়েছে, গ্রামে বিঘা দশ জমি। মাঝারি জোত। একটি গাই (বকনাসুদ্দো), দুইটা বলদ, একখানি লাঙল, একটি গো-গাড়ি, মই, বিদে ইত্যাদি স্থাবর-অস্থাবর। জোত দেখেন বাপ, লালুও মাঝে-মিশেলে জমিতে নামে। তবে ব্যবসায় ঝোঁক। মাস কতেক হল বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে বিশেষ কিছু বিঘœ গোলযোগ অবশ্য ঘটেছিল। শোনা যায়, সঞ্জয় নামের এক যুবককে ফাঁকি দিয়ে ময়না লালুর বউ হয়েছে। শুভদৃষ্টির সময় ময়নার চোখে জলপ্লাবন ঘটে, বরের মুখচোখ তাতে করে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। চোখের জলের সেই খবর গ্রামগঞ্জে রাষ্ট্র হয়েছে। আজও নাকি বউ বরের চোখে চোখ রাখে না। স্বামীর পায়ের নখে চোখ রেখে কথা বলে।

বিয়ের আসরে দধিডাঙার একদল যুবক এসে চড়াও হয়ে বিয়ে বানচাল করতে উদ্যত হয়। ওই যুবকদল শোনা যায়, সঞ্জয়ের বন্ধু-প্রতিবেশী, কেউবা ছাত্র। সঞ্জয় বেকার, টিউশান করে খায়। বাপ একজন দরিদ্র কুমোর। একখানা চাক আছে।

দধিডাঙা থেকে দুর্লভপুর উড়ে এল পাখিটা। বাড়ির পাঁচিলের উপর বাইরে থেকে ঝুঁকে থাকা সজনের ফুলপাতা-নালে-ভরা ডালে এসে একটা টই দিয়ে বসল রাখালভোগায়। তার গায়ের রং পেঁচার মতন ধূসর। তার চোখ দুটি কাজলটানা, ফলে তার বাঁকা করে তাকানোর ভঙ্গিমে বিশেষ সুন্দর হয়ে ওঠে। তার মনের ধূর্ততা মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। সে একেক দিন একেক জনকে বেছে নিয়ে তাক করে। তারপর সম্মোহন করে।

হাতের ঝাঁট থেমে গেল ময়নার। সাইকেল নিয়ে গঞ্জের দোকানে বার হচ্ছে লালু। সে লক্ষ করে, বউ কোমর সটান করে দাঁড়িয়ে উঠে, ভ্যালভেলে চোখে সজনে গাছটার দিকে চেয়ে আছে।

Ñ কী দেখছ অমন করে, ময়না?

Ñ কই, না তো। মনে হল বাজ। তাই।

Ñ না, ওটা বাজ নয়। যদি বাজ হত, তাহলে, পাশের বাড়ির মোরগটা যে আমাদের উঠোনে এই ভোরে খুঁটে খেতে এসেছে, সে বেচারি গলা খাড়া করে ডাকত আর ভয়ে কাট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। আপন মনে খুঁটে খেত না। ওটা বাজ নয়। ওটা বউ-ফুসলানি, রাখালভোগায়। শোনো, একফোঁটা খাতির করবে না। চাইবে না ওর দিকে। তুইমুই করে ডেকে উঠবে না। যদি করো, বিপাকে পড়বে।

Ñ কী যে বলেন! সামান্য পাখি। তার কী সাধ্য! এসেছে। চলে যাবে। বলে নিচু হয়ে মাটির উঠোনে ফের ঝাঁটা চালাতে শুরু করে কালোসোনা।

Ñ তুমি আমার কথা কাটছ সোনা। ঠিক নয়। যা বলছি, মন দিয়ে শোনো।

Ñ যা বলছেন শুনেছি। ও আপনা থেকে উড়ে যাবে। পারলে তাড়িয়ে দিলেই হয়।

Ñ এইভাবে তর্ক আমার ভালো লাগে না।

Ñ তর্ক কোথায়! আমি বলছি, বেচারি কিছুক্ষণ দেখবে, তারপর উড়ে যাবে। যান গঞ্জে যান। একটা অবলা পাখি, তাকেও আপনি এভাবে সন্দেহ করেন?

স্ত্রীর এ কথায় স্বামীর অত্যন্ত গুমরে লাগল। তার মনে হল, এই নারী নেহাতই অবাধ্য। হঠাৎ গলা তুলে মাকে ডাক দেয় মানিকলাল। মা তড়িঘড়ি ছুটে আসেন।

অবাক হয়ে শঙ্কিত-স্বরে বলেন, কী হয়েছে লালু?

মায়ের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়ে মুখ পানসে করে মানিক বললে, কী আবার হবে! এই সাতসকালে একটা রাখালভোগায় দধিডাঙার বিল পেরিয়ে উড়ে এল। তখন ব্রাশ করছি দাঁতে, দেখলাম, কুসুম-কুসুম সুয্যিটার গা-ঘেঁষে বিলের উপর ভেসে ভেসে আসছে। কোথাও রেস্ট নিল না, একটা কোনও ডালের উপর বসল না পর্যন্ত। সিধে চলে এল সজনে গাছের ডালের উপর। তারপর কত রকম কেতা করে যাচ্ছে। মানে কী? একটা বউ-ফুসলানি চারশো বিশ পাখি। মা, তুমি এবার সামলাও। সামান্য একটা বনের হরিণ, সীতাকে কেমন পটকেছিল মনে আছে? কথায় বলে, সকালের লক্ষণ দেখে বোঝা যায় দিন কেমন যাবে!

Ñ হায় ভগবান! সত্যিই তো, রাখালভোগায়! ওরে, তাড়াÑ তাড়া! দেখছিস কী! এত ভোরে বউয়ের উপর নজর দিয়েছে, এ কিন্তু ভালো কথা নয় মানিকলাল; আচ্ছা তুই কাজে যা, আমি দেখছি।

এই বলে হরিমতি দৃষ্টি কঠোর করে ময়নার দিকে চাইলেন।

তারপর কর্তব্যরত বউমাকে বললেন, ওগো মেয়ে, তুমি ঝাঁটা ফেলে ঘরে যাও। আমি ওটাকে তাইড়ে দিই, তারপর উঠানে নামিও। দেখো বউ, সংস্কার মানতে হয়।

শাশুড়ির কথায় সুন্দরী-শিক্ষিতা (কলেজে পড়তে-পড়তে বিয়ে) বউ নিতান্ত অবাক হয়েছে। হাতের কাজ থামিয়ে সে সিধে হয়ে দাঁড়ায়।

পাখিটাকে দেখে। তারপর বলে, সংস্কার কীসের বুঝিয়ে দিন আগে, তারপর ঘরে যাব। যা তা পাগলামো করছেন আপনারা। দেখুন, দোষ আমার। দোষ কারও নয়। যখন-তখন সঞ্জয়ের বাবার ওপর চড়াও হচ্ছেন আপনারা। মাধবজ্যাঠা কার কী করেছে?

Ñ সঞ্জয় করেছে। করেনি? বিয়ের দিন হাঙ্গামা করতে লোক পাঠায়নি? বলো তুমি, দোষ নয়? দোষ আর কাকে বলে? অমন তড়পানি সইব কেন? বিয়ের আসর থেকে বউ ছিনতাই করতে যে ছেলে দল পাঠায়, তাকে শায়েস্তা করাই তো উচিত। সেই উচিত কাজই তো হয়েছে। অত দুঃখ কীসের তোমার বউমা? যা বলছি শোনো। তুমি ঘরে যাও। ছেলে কাজে যাচ্ছে, এখন নাটক করিও না। এই বলে ফুঁসতে থাকেন হরিমতি।

এই বাড়িতে এসে থেকে এমনটাই হচ্ছে। কলহপরায়ণ, মুখরা শাশুড়িকে ময়না আর পেরে উঠছে না। বরাবরই ময়না কারও সঙ্গেই বেশিক্ষণ তর্ক চালাতে পারে না। প্রথমে কিছুটা তেড়ে উঠেই মিইয়ে পড়ে। মাধবজ্যাঠার উপর এত অন্যায় এরা করেছে, যা কহতব্যই নয়, এ এক চরম নিষ্ঠুরতা। চড়াও যারা হয়েছিল বিয়ের দিন, তাদের সত্যিই তো আর হাঙ্গামা করতে পাঠায়নি সঞ্জয়। দল পাকিয়ে নিয়ে ছুটে এসেছিল যে লোকটা, নাম তার ত্রিদিবচন্দ্র বসাক ওরফে মালু। আসলে বিপতœীক মালু নানা চেষ্টা করেছে ময়নাকে বিয়ে করার বাসনা ফলাতে। বয়েস চল্লিশের কাছাকাছিÑ দুই ছেলের বাপ। ময়নার বাপ যদু নন্দী সেই প্রস্তাব তিন-তিনবার প্রত্যাখ্যান করেন। ময়নাও বলেছে, আমি পড়াশোনা করছি, এখন বিয়ে কীসের! কলেজ শেষ না করে বিয়েটিয়ে হবেই না। তাছাড়া দুই ছেলের বাপকে বিয়ে করব কোন দুঃখে!

কিন্তু কতক ব্যাপার মানুষ বুঝতেই চায় না। মালুর টাকা আছে। টাকা থাকলে বিপতœীকের লজ্জা থাকে না। দুই ছেলের বাপ তো কীÑ টাকাই তো মানুষের আসল মর্দানি, যদু নন্দীর মেয়েটাকে তার চাই! নন্দী বাড়িতে সময়ে-অসময়ে নানান উপঢৌকন পাঠাতে থাকল টি সি বসাক। যদু নন্দী সেই সব জিনিস বসাকবাড়ি ফেরত দিয়ে এলেন। যতবার পাঠালে ততবার। তবু মালু মাস্টার নিরস্ত হল না। বুঝতে চাইল না নন্দীর স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান। এরপর নন্দীকে রাস্তাঘাটে যেখানে পেল অপমান করে যেতে লাগল।Ñ আমার জিনিস ফিরত করলে নন্দীমশাই। মাড়োয়ারির গদিতে খাতা লিখে যার পেট চলে, তার এত দেমাক কীসের হে! মুখে জুতা খাইবার ইচ্ছা করেছে, নয়? আমি চাই, আমার দেয়া ধুতি-বেনিয়ান পরে গদিতে খাতা লিখতে আসো। আর এক হাঁড়ি রসকদম্ব দিচ্ছি, নিয়ে যাও। বউঝিকে খাইও। ময়না খেলে তৃপ্ত হই বাপ! বলি কী, আর ফিরত করিও না। বিপদ আছে। শোনো হে, আমার বাপ ভিটাখোর স্বর্ণকার। তোমার দেড় বিঘার খতেন আজও বাপের কাছে বাঁধা পড়ে আছে। চাও তো ফিরত করি।

নন্দী যথারীতি ভয় পেলেন এবার। হঠাৎ তাঁর মনে হল, জিনিস ফেরত করে তিনি ঠিক করেননি। তাছাড়া, দেড় বিঘা ফেরত পেলে মন্দ হয় না। এই জমি বন্দক রেখে তিনি বড়মেয়ের বিয়ে দেন। আজও ছাড়াতে পারেননি। এবার হবে।

যদু নন্দী সরল আর ভীতু প্রকৃতির মানুষ। বার তিন প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবার মনে মনে কেমন দমে গেলেন। তাঁর তিন মেয়ে। মেজোমেয়ে কালোসোনা ওরফে ময়নাই বলতে গেলে বাড়ির গার্জেন। মেয়ের মুখের উপর কথা কাটাকাটি করে শাসন করা, কড়া কথা বলা তাঁর ধাতে নেই। ময়নার কথা তিনি পারতপক্ষে কাটেন না, কাটলে নরম করে আপত্তি জানিয়ে ছেড়ে দেন। মেয়ে তাঁর সুন্দরী। তিনটিই বিশেষ সুন্দরী। তার মধ্যে মেজোটা একেবারে ‘পিওর’ দুধে-আলতা। অথচ জšে§র সময়, তারপর মাস তিন, ময়নার গায়ের রং ছিল বেশ কালো। তিন মাস পর সে রং ধরতে শুরু করে। দেখতে দেখতে আশ্চর্য রূপ ধরলে ময়না। তখন বাপের মনে হল, এ যে কালোসোনা নয় হে, এ মেয়ে আসল সোনাই নিশ্চয়। কোনও একটা ক্লাসে কখনও ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি। এমন মেয়ের তো ‘জজ-মেজিস্টেট’ হওয়ার কথা, পয়সার জোর থাকলে, যদু ময়নাকে ডাক্তার করে দেখাতেন। কিন্তু গ্রামঘরে এসব আকাক্সক্ষা ঘোড়ারোগ ছাড়া অধিক কী? তাছাড়া গরিব ঘরে রূপসী মেয়ের ভাগ্যে অভিশাপ থাকে। হলও তাই, গরিব বাপের মেয়েকে দুই ছেলের বাপ হেনস্তা করতে উঠে পড়ে লাগল।

বড়মেয়ে রূপা সুন্দরী বটে, কিন্তু তোতলা। দিন যত যাচ্ছিল, জিভের আড় ভেঙে তার তোতলামি কমছিল। পড়াশোনায় তার তত মাথা ছিল না। ফলে বিয়েটা তার ভালো হল না। পাটের এক দালাল ধরে বাল্যেই তার বিয়ে হয়ে গেল। দেড় বিঘা জমি বন্দক পড়ল মালুর কাছেÑ তখন মালুর বউ বেঁচে। সে জমি আর ছাড়াতে পারেননি যদু। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছে কী দেখো, বিয়ের বছর তিন বাদে রূপার যেই বাচ্চা হল, বাচ্চার সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে বলতে রূপার তোতলামি গেল সেরে। দালাল জামাতা সংসারে মোটেও উন্নতি করতে পারেনি। পাট আর রবিখন্দের ব্যবসায় হরসন লোকসান খেয়ে একেবারে শুয়ে পড়েছে। রূপার বর আর সন্তানকে মাসে-মাসে অর্থ সাহায্য করেন যদু। তাছাড়া রূপার যে চলে না।

এই অবস্থায় ময়নাকে নিয়েও যাদব ওরফে যদুর ভাবনা। সম্বন্ধ যা আসে, সব গরিব। আসলে দধিডাঙা গরিব জায়গা। এখানে রূপ আর বিদ্যার চেয়ে টাকার দাম বেশি। রূপের তত কদরও এখানে নেই। বিদ্যারও নেই। মেয়েমানুষের রূপইবা কী, বিদ্যাইবা কী? এখনও কদর হয় না। বিদ্যা আর রূপ বড়লোকের ব্যাপার।

অথচ গঞ্জের গা-ঘেঁষা গ্রাম চৈতন্যপুরে রূপ আর বিদ্যা দুইয়েরই কদর কিছু হয়েছে। কিন্তু পুরা চৈতন্যপুর বামুনদের জায়গা। ওরা আমাদের সম্বন্ধ করে নেবে না। এই কথাই ভাবতেন যাদব। আর এদিকে দুর্লভপুর-দধিডাঙা ইত্যাদি প্রধানত সংখ্যালঘু মুসলমানের জায়গা। জলা জায়গা। খালবিলে ভরা। নদী আছে। হাইস্কুল নেই। পাঁচ মাইল দূরে চৈতন্যপুর হাইস্কুল। বর্ষার সময় ছেলেমেয়েরা ডোঙা করে স্কুল যায় অথবা যায় না। প্রত্যেক বর্ষার পর চৈতন্যপুরের হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রী কমে যায়। দুর্লভপুরের পাঠশালা বর্ষায় বন্ধ থাকে। স্কুলে গোরুছাগল বাঁধা হয়।

এই রকম জায়গায় বিদ্যা ও রূপের কদর হওয়া কঠিন। দধিডাঙার কথাই বল আর দুর্লভপুর। দুর্লভপুর, তবু তো কিছু ভালো। আসলে উনিশ-বিশ। ও গ্রামেও ব্রাহ্মণ নেই। যাই হোক। মেয়েকে হস্টেলে রেখে শহর-সদরে পড়ানো যাদবের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর দেনা হয়েছে। শুধবার ব্যবস্থা নেই। জমিটাও বন্দক রইল। দানাপুরের মালু তাই যাদবকে লোভ আর ভয় দেখায়। ধুতি-বেনিয়ান-রসকদম্ব দেয়। তারপর ধমকি দেয়। যাদবের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।

দানাপুরের হাটে এই রূপে ‘হেটা’ হন যদু। রসকদম্বর প্রকাণ্ড হাঁড়ি কাঁধে গঞ্জের দিকে এগোতে থাকেন নন্দীমশাই। তাঁকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ধুতি-বেনিয়ান, পায়ে দেওয়া হয়েছে নীল ফিতের হাওয়াই চপ্পল। একটি নতুন গামছাও দেওয়া হয়েছে। গামছার এক প্রান্তে বেঁধে দেওয়া হয়েছে পান-সুপারি। যেনবা ময়নাকে টি সি বসাক বায়না করে রাখল।

মাধব প্রথম যৌবনে কথকতা করতেন। যাত্রাপালায় নট সেজেছেন। শেষে বছর দুই পঞ্চরসও করেন। গানবাজনায় তাঁর জমিজিরেত নষ্ট হয়। কারণ তিনিই ছিলেন দলের অধিকারী। যাত্রাপালা আর পঞ্চরসে সেই জমি গেল। মানুষটি বড় বিদ্বান হতে পারতেন। জীবন তাঁকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। বিভিন্ন চকের ব্যবসার গদিতে মানুষটি এখন হিসাব-রক্ষকের কাজ করেন। পাশ করা বিদ্যা না থাকলেও খাতার কাজে তিনি দক্ষ। চার জায়গায় খাতা লিখে তাঁর সংসার চলে।

শিল্পীমন বলেই তিনি নারীর রূপের কদর বুঝতেন। অথচ চারপাশে মানুষজন সব অন্যরকম। বিদ্যা বোঝে না, রূপও বোঝে না। একটা প্রকৃত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজই এখানে গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ পরিবারেই প্রথম প্রজš§ স্কুল যাচ্ছে।

এই দিগরের সংখ্যালঘু সমাজটা রূপবিদ্যার কদর বোঝে না, সে না হয় বোঝা গেল, তাদের সংস্রবে থাকা জনসংখ্যার দশ ভাগ যে বাঙালি হিন্দু, সে-ও কেন নারীর সম্মান দেয় না? টি সি বসাক তো বধূহত্যা করেছে। সারা তল্লাট জানে, ওর বউ বিষ খায়নি। বালিশ চেপে বউকে মেরে দেয় মালু, তারপর মরা বউয়ের মুখে-গতরে ফলিডল ছড়িয়ে দেয়। লোকটা আবার প্রাইমারির প্রধান পণ্ডিত। দেখা গেল, বসাকের কোনও শাস্তি হল না। টাকা ঢেলে চল্লিশী লোকটা দিব্যি বেঁচে গেল। থানাকে মোটা টাকা খাইয়েছে বলে শোনা যায়। এই লোক যদি টি সি বসাক, আমিও তাহলে জে সি নন্দী। অধিকারী ছিলাম মশাই। বেশি বয়েসে ঘর বাঁধলাম। তার আগেই ফৌত হয়েছি হে ঠাকুর। বলতে বলতে আপন মনে চলতে চলতে নির্জন পথের উপর থমকে দাঁড়িয়ে একাকী ডুকরে উঠলেন যদু নন্দী। যিনি খাতার হিসেব কষে জে সি নন্দী স্বাক্ষর দিয়ে তারিখ বসিয়ে রাখেন। আজ হঠাৎ তাঁর মনে হল, ময়নার ভবিষ্যৎ নেইÑ মেয়েটি এই সংসারে বড্ড দুঃখ পাবে। বিয়ের পর হয়তো মরবে। বিষ খাবে। কলেজ-পড়া হয়তো তার আর ভাগ্যে নেই।

হঠাৎ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন একাকী এই অধিকারী কথক যদু, না দোব না। মেয়েকে কুপিয়ে কেটে ভৈরবের জলে দোব, তবু ঘাতকের ঘরে মেয়ে দোব না। দোব না। দোব না। দোব না।

গঞ্জে পৌঁছে মানিকের আড়তের সামনে কাঁধ থেকে রসকদম্বের হাঁড়ি আছাড় মেরে ফেললেন নন্দীমশাই। হাঁড়ি ফেটে রসকদম্ব ছড়িয়ে গেল কিছু, বাকি পড়ে রইল ভাঙা হাঁড়ির গর্তে। বাজারের বেড়াল-কুকুর ছুটে এসে খেতে শুরু করল। কাছেই ছিলেন মাধব পাল।

মাধব ছুটে এলেন যাদবের কাছে।

মানিক অবাক। মানিকের বড়দা আরও অবাক। বড়দা সুভাষ এসে দরদর করে কাঁদতে থাকা নন্দীমশাইকে হাত ধরে টেনে ভাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে তালপাখার হাওয়া দিতে লাগল।

সব শুনেটুনে সুভাষ সরকার বললে, চোখের জল ফেলবেন না কাকা। নন্দীকাকা, আমরা তো আছি। ওই জমি আমি ফেরত করাব। বোনটির আমার ভালো বিয়েও দেব। তবে হ্যাঁ, দেরি করা চলবে না কাকা। কৌশল নিতে হবে। ময়না কলেজ পাশ করবে বিয়ের পর।

জে সি নন্দী, যাকে লোকে অধিকারী নন্দী বলে, সেই যদু ছিলেন, চড়া আবেগপ্রবণ। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতেন এবং বিশ্বাসভঙ্গ হলে খেপে গিয়ে দু’চার রাত্রি ঘুমোতে পারতেন না।

আবেগের মাথায় সুভাষকে বললেন, কৌশল লাগাও বাপ, যা করে হোক বউমারা মালুকে ঠেকাও। হ্যাঁ, বিয়ের পর ময়না পার্ট-টু দিবে। আমার মেয়ে সুন্দর, বুদ্ধিমতী-মেধাবী, দেখো, দেখো যেন না ঠকে বাছা। আর মিতে মাধবকেও বলি, আপনার ছেলে সঞ্জয় বেকার। চাকরির সন্ধান নাই। থাকলে ময়নাকে আপনার ঘরেই দিতাম। মাফ করবেন মিতে। পারা গেল না।

মাধবজ্যাঠা আড়তে বসে কোনও কথাই বলতে পারলেন না। শিক্ষিত হয়েও ছেলে বেকার বলে তাঁর লজ্জা করতে লাগল। তিনি ফ্যালফ্যাল করে কুকুরের রসকদম্ব ভক্ষণ দেখতে থাকলেন।

কেবলই বলতে থাকলেন, বেড়ালেও রসকদম্ব খায়, আচ্ছা রাক্ষস তো! হুলোটা খাচ্ছে না, মেনিটা খাচ্ছে, কী বেবাক কাণ্ড সঞ্জয়! ওরে, নাটক তো শেষ।

বলেই মাধব পাল আড়ত ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেলেন। টি সি বসাক এরপর একদিন ইতোমধ্যে সঞ্জয়কে দানাপুর ডেকে পাঠাল।

ডেকে পাঠিয়ে সঞ্জয়কে মালু মাস্টার বলল, শুনেছি তোমার লাভার।

সঞ্জয় বলল, লাভার নয় মাস্টারমশাই। ও আমার লেডিলভ। মেয়েদের লাভার বলতে নেই।

Ñ ওরে শালা, এ যে দেখছি ইংরেজি গ্রামার পড়াচ্ছে পণ্ডিতকে। তা বাবা কুমিরকে কুম্ভীর না বললেই নয়? যা হোক। কিন্তু ভাই, তোমার লাভারকে আমি রসকদম্বে বায়না করেছিলাম। শুনেছ?

বললে মালু।

সঞ্জয় বললে, এখন সে কথায় লাভ কী আজ্ঞে! দেখুন, মানিকের দাদা সুভাষ ময়নার মুখ-দেখানি করে পাকা-দেখা করে দিয়েছে। এই অবস্থায় কী আর কষাকষি করবেন! বরং পারলে বন্দকি জমিটা নন্দীমশাইকে ফেরত দিন।

সঞ্জয়কে এরপর বেশ ক’বার টি সি বসাকের বাড়ির বাইরের প্রাঙ্গণে দেখা গেছে। যতবার সঞ্জয় গেছে, অনেকক্ষণ কথা বলেছে ওরা। লোকের ধারণা হল, একটা কোনও সাঁট ওদের হয়েছে। এ বিয়ে ওরা হতে দেবে না। কিন্তু ময়না বিশ্বাস করতে চায়নি, সঞ্জয় সাঁট করছে। অত ঘোড়েল ছেলে সঞ্জয় নয়। বরং বড্ড ভীতুর ডিম। সাহসই নেই কোনও।

একবার মুখ ফুটে বলল না পর্যন্ত, তোমাকে ভালোবাসি কালোসোনা, এ বিয়ে তুমি কোরো না। তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।

একবারের তরেও তো বলতে হয় কথাটা। দেখা গেল, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তা, পালিয়ে বেড়াও ঠিক আছে। বুঝলাম যে তোমার সাহস নেই। কিন্তু তাই বলে মালুর সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র! ময়না ভাবছিল, এ কাজ সঞ্জয় করবে না। কিন্তু মালুর চালে পড়ে যদি বিগড়ে যায়! মানুষের দুর্মতি হতে কতক্ষণ! এই সব ভাবতে ভাবতে বিয়ের দিন এগিয়ে এল। বিয়ের আসরে হামলা করল ওরা।

তারপর? তারপর সরকাররা গুষ্টিবাদী লোক। সুভাষ সরকার, যে লোক লাটের ব্যবসা করে বড়লোক, আলাদা জমিজিরেত করেছে, সে গুষ্টির লোক জুটিয়ে বিয়ের পর দিন সাতের মাথায়, মাধবজ্যাঠার উপর চড়াও হল। বিরাট ক্ষতি করে দিল মাধব পাল মশাইয়ের।

ভৈরব নদীর ভাটিতে নিধিনগরের মেলায় মৃৎপাত্র বেচতে যান জ্যাঠা। প্রত্যেক সাল মেলার জন্য তাঁর আলাদা তৈয়ারি। মাটির নানান আসবাব, বিচিত্র সব পাত্রাদি গড়েছেন তিনি, অতি বিচিত্র রং দিয়েছেন পাত্রে। যেনবা রামধনু ঠিকরে পড়ছে রঙের বাহারে। ঘাটে নৌকা নিয়ে গকুল মাঝি বসে রয়েছে। মাল সব মাথায় চড়িয়ে খেপ নিয়ে সাজানো হবে নৌকায়। তারই তোড়জোড় চলছে।

এমন সময় হামলা করল সুভাষের গুষ্টি। যেন ডাকাত পড়ল রে-রে করে। সমস্ত হাঁড়িকুড়ি লাঠির ঘায়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে। জ্যাঠা বাধা দিতে গেলে লাঠির ঘা খেলেন মাথায়। মাথা ফেটে রক্ত চুঁইয়ে পড়ল গাল বেয়ে। সুভাষ যে গুষ্টিবাদী, লাঠির জোরে চলে, এমন একটি বদনাম আগেই শোনা গিয়েছিলÑ এখন বোঝা গেল, লাঠি কত বলবান। অবশ্য বিয়ের দিন হামলায় ময়নার শ্বশুরের মাথায় ছাতির বাঁট পড়েÑ এ তারই প্রতিশোধ। তবে শ্বশুরের রক্ত ঝরেনি। মাথা ফুলে গুটলি হয় মাত্র।

মাধবজ্যাঠার মাথায় ব্যান্ডেজ পড়ল। গাঁয়ের এক মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী মাধবের ব্যান্ডেজ করে দিলে। ব্যস। রূপা এল ময়নার কাছে। অষ্টমঙ্গলায় বোনকে নিয়ে যেতে এল দধিডাঙা। রূপার সঙ্গে বাবাও এসেছিলেন। গো-গাড়ি করে যাওয়ার পথে পালপাড়ায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে জ্যাঠাকে দেখতে নেমেছিল কালোসোনা। ব্যান্ডেজ বেঁধে বসে আছেন তিনি। সামনে ছড়ানো চুরমার মৃৎপাত্রের টুকরো ডাঁই হয়ে জ্যাঠাকে একেবারে বসিয়ে দিয়েছে। মাধবজ্যাঠা নন্দীমশাই বা ময়না, কারও সঙ্গে কোনও কথাই বললেন না, খালি ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন। চোখের কোনা চিকচিক করে উঠল। মাধবজ্যাঠা বরাবর স্বভাব-কুণ্ঠ মানুষ, কথা বলতে পারেন না। শুধু নিঃশব্দে হাসতে জানেন। কাঁদতেও পারেন কম। বোকা মানুষ। জ্যাঠা ওইভাবে বসে রয়েছেন। সঞ্জয়ের মা দয়াময়ী মুখে আঁচল চেপে ফুঁপিয়ে উঠলেন।

তারপর দয়াময়ী ধরা গলায় বললেন, নন্দীমশাই, বিয়ে দিলেন আপনি, পালমশাইয়ের এই দশা করে গেল সুভাষ। আমার সঞ্জয় কারও সাতে-পাঁচে থেকেছে কোনও কালে। আপনার মেয়ের বিয়ে ভাঙবার সাধ্য ওর আছে! বিয়েতে যারা চড়াও হয়ে হাঙ্গামা করেছে, তাদের শুধোও তো, কে তাদের হুজ্জোত করতে পাঠালে! ঠাকুরের ফটোতে হাত রেখে সঞ্জয় বলেছে, ঠাকুরের দিব্যি মা গো, আমি ওদের বলিনি মোটে, তবে লোভ হয়েছিল, টি সি বসাক যদি গা-জোয়ারি করে ময়নাকে পাইয়ে দেয়, মন্দ কী! তবু বড্ড ভয় করল মা। ওরা যখন যাচ্ছে, সবার আমি হাতে ধরে বললাম, জোর করে এনো না, নিজে থেকে ময়না আসতে চাইলে এনো। মালু এই সবই জোর করে করালে মা দয়াময়ী, তুমি অন্তত বোঝো। পাগল ছেলের হঠাৎ তারপর মনে হয়েছে, মালু ময়নাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে কী করত বলা যায় না। হয়তো মালু নিজেই বিয়ে করত কিংবাঃ এই পর্যন্ত বলে ঠাকুরের সামনে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলে। তারপর বিয়ে হয়ে গেছে শুনে সঞ্জয় কেমন আÍহারা হয়ে পাগলের মতো আনন্দে আমাকে জড়িয়ে বললে, মা দয়াময়ী, তোমার ঠাকুর আমাকে বাঁচিয়েছে, কালোসোনা সুখী হোক, মা গো। আমাকে যে দয়াময়ী বলে ডাকে, সে যে কী পাগল, নন্দীমশাই, আপনার মেয়ে ময়না কি বোঝে না! তবু ওই যে ‘লোভ’, তাইতেই মার খেলাম আমরাÑ এই বলে সঞ্জয় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ি থাকে না। বাপটা এদিকে পুরা বসে গেল। সুভাষ এত ক্ষতি করে গেল। হায় ভগবান!

এখনও তুমি অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে বউমা! তোমাকে না ঘরে যেতে কইলাম! এই বলে ময়নাকে ফের ডেঁটে ওঠেন হরিমতি।

ময়না এবার হাত থেকে ঝাঁটা ছুড়ে ফেলে পা ঝামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। এবং ঘাড় বাঁকিয়ে পাখিটাকে দেখতে থাকল।

লালু ফুঁসতে ফুঁসতে বললে, আমি আড়ত খুলতে চললাম। কথা একটি কই, তুমিও মনে রাখিও মা! রেতে ফিরে বউডারে যেন আস্ত পাই। ওই যে ঠাকুমা কইতেন, রাখালভোগায় বাদে লাগলে বউমানুষের গোটা থাকাই কঠিন। গোটা বউ না পাইলে ছেলে তোমার সন্ন্যেসী হবে হরিমতি, বলে গেলাম।

এই বলে সাইকেল নিয়ে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে যায় মানিকলাল। তার মূল বিক্ষোভের হেতু আজও সংসার জানে না। সে কথা অবশ্য যথাস্থানে প্রকাশ্য। ক্রমশ প্রকাশিতব্য।

ছেলে রাস্তায় নেমে গেছে। সাইকেল করে ছুটল গঞ্জ। হায় কপাল, পাখিটা যে কেরামতি শুরু করে দিলে। গাছ থেকে গাছে। ডাল থেকে ডালে ছোঁ মারছে। বউকে তাক করছে।

পেয়ারার সবচেয়ে নিচু ডালটায় নেমে এল। এবার আর সইতে পারলেন না হরিমতি। হাতের ন্যাতা ফেলে দিলেন ছুড়ে। তারপর ছুটে বার হয়ে গেলেন বাড়ি ছেড়ে। পাড়ার ছেলেদের হাঁক পেড়ে পেড়ে ডাকতে লাগলেন। ওরে শাম, ওরে নন্দু, ওরে সাগর।

ডাক শুনে এগিয়ে এল ছেলের দল। হরিমতির নির্দেশে পাখিটাকে তাক করে ইট-পাথর ছুড়তে শুরু করলে। এই পাখিটার উপর মানুষের এত আক্রোশ কীসে ময়না বুঝে পেল না। রাখাল-বাগালরা এই পাখিটার সঙ্গে খেলা করতে করতে বাগে আসছে না দেখে গুলতি ছুড়ে মেরেও তো দেয়!

কালোসোনার একটি অবশ্য তোলা নাম আছে। স্কুল-কলেজের খাতায় সেই নাম ব্যবহার হয়। সেই নামে এই ভোরে হঠাৎ কে যেন দূর থেকে ডাক দিলে, ‘নির্মলা’! তখনই বুকের ভেতরটায় কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।

উঠোনে দাঁড়িয়ে তার হাত-পা কেমন কেঁপে উঠল।

সেই দূরের কণ্ঠস্বর তার কানের কাছে এগিয়ে এল। বললে, ময়না বলে লোকে তোমায় ডাকে। তুমি একটি পাখি। রাখালভোগায়, সে-ও তো একটা পাখি নির্মলা! তাকে বাঁচাও! মানুষ মানুষকে দেখে, পাখি পাখিকে দেখবে না! কে দেখবে তাহলে?

ছেলেরা ইট-পাথর ছুড়ছে। তবু রাখালভোগায় কালোসোনার কাছে নেমে আসতে চায়! বাড়ির বিভিন্ন গাছের ডালে ডালে গা বাঁচিয়ে উড়ে গিয়ে বসছে। তারপর ঘাড় কাত করে নির্মলাকে দেখছে। মনে হচ্ছে আঁচলে নেমে আসার ইচ্ছে। কী বোকা একটা পাখি। সমাজের মানুষকে চিনল না! কে কেমন জানল না। খালি উড়ে উড়ে বউ-ভোলাতে বার হয়েছে।

Ñ নচ্ছার পাখিটাকে শেষ করে দে নবু। মানিক ফিরলে দেখবে, আমি কেমন মেরে রেখেছি! যাঃ, পঞ্চাশ টাকা ইনাম পাবি। বাঁটুলÑ গুলতি নে আয়! বলে হরিমতি চেঁচিয়ে বুক ফোলালেন।

Ñ মা! আপনি এ জিনিস করবেন না। বনের পাখি, ও কী এমন দোষ করেছে যে অমন করে মারতে বলছেন! বিনে দোষে পালজ্যাঠার ওপর হামলা হল। সব হাঁড়িকুড়ি ভেঙে চুরমার করলেন! মাথা ফাটিয়ে দিলেন! সব আমিও মুখ বুজে সয়ে যাচ্ছি মা! আমার কলেজ-পড়া বন্ধ করে দিলেন! সমাচার এই যে, সঞ্জয় পাগল হয়ে গেছে, রাস্তায় পেলে মানিকের বউকে ছাড়বে না। মালু নাকি পাগল সঞ্জয়কে মদত দিয়ে রাস্তায় ছেড়েছে। অতএব কলেজ বন্ধ। আসলে আপনারা মালুকে ভয় পান। শুনেছি, ভাসুর সুভাষের শত্র“ ওই মালু। একসঙ্গে পড়ত স্কুলে। রোজ ওদের মারপিট হত। সেই রেষারেষির কারণ ছিল স্কুলের সহপাঠিনী রেবা। শোনা যায়, ওই দু’জনকেই রেবা লড়িয়ে দিয়েছিল। এখন আমাকে নিয়ে পড়েছে। সঞ্জয়কে ভয় দেখানো, মাধবজ্যাঠার সর্বনাশ করা, এতেই ভাসুরের সুখ। ভাসুর মালুকে এইভাবে খেপাচ্ছে। কী মানুষ আপনারা, কখনও ভেবে দেখেছেন! ছেলে চায় আস্ত বউ! ছিঃ!

এই বলে, লম্বা সংলাপ শেষে হাঁপিয়ে পড়ে নির্মলা। তারপর উঠোন পেরিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে বিছানার উপর উপুড় হয়ে পড়ে দু’হাতে বালিশ আঁকড়ে ফোঁপাতে থাকে। বাইরে মানুষের শিকার-পর্ব শুরু হয়। ছেলেদের উৎসাহ দিতে বড়রাও এসেছে। দারুণ শোরগোল পড়ে যায় পাড়ায়।

বালিশের তলা ঠেলে বেরিয়ে পড়েছে কন্ডোমের প্যাকেট। এ এক মর্মান্তিক বিষয়বস্তু। প্রচণ্ড ক্রোধ হয় বস্তুটার প্রতি। যতদিন কলেজের শেষ পরীক্ষা না হয়, ততদিন এ জিনিস চলবে। যেদিন রেজাল্ট বার হবে, সে রাতে নির্মলা স্বামীকে প্রকৃত দেহ দেবে। তার আগে নয়। কিন্তু আজ নির্মলার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল জিনিসটার ওপর। এ যেন জীবনের এক পরিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলেজ গেল বন্ধ হয়ে। ডক্টর কন্ডোম রইলেন। রইলেন সহবাসে অনিবার্য। রাতের নিভৃতে হিসহিস করতে থাকে স্বামী। কাম আর ক্রোধে ফোঁসে। স্ত্রী বলে, পার্ট-টু শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডক্টর কন্ডোম থাকবেন। প্রকৃত দেহ আপনি পাবেন না মিস্টার হাজব্যান্ড। এটাই দস্তুর হয়েছে কিনা! কথাÑ কথা, এর ব্যত্যয় হবে না মশাই! যান, যা হওয়ার হল, এ বার ঘুমিয়ে পড়-ন। ভোরে দোকান খুলতে হবে।

দুপুর হল। পাখিটাকে মাঠের মধ্যে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বালকের দল। ওরা তারপর কী করেছে এখনও খবর নেই। চারিদিকে বসন্তের সৌরভ আর শান্ত গুঞ্জন। দখিনা বাতাসে দিগন্ত থেকে বয়ে আসা নদীর কুলুধ্বনি, এক ঝিরঝিরে গান। কোথাও একটি কোকিল কেবলই ডাকছে।

দরজা খুলে বাইরে এল নির্মলা। উঠোন শান্ত। ওই দিকে শাশুড়ি বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বুকের কাপড় সরে গিয়ে প্রকাণ্ড একটি স্তন ঈষৎ ঝুলে রয়েছে বোবা একটি গ্রহের মতো।

হঠাৎ দরজার কাছে নবুকে দেখা যায়। কিশোর বললে, ওগো বউ। রাখালভোগায় ডিহির বাগানে সেঁধিয়ে গেছে। বাটুল লাগেনি, এ যাত্রা বেঁচে গেল। চলি।

নবু চলে যেতেই সজনের ডালে তাকে আবার দেখা গেল। শিউরে উঠল কালোসোনা।

দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ওগো নির্মলা! আসো, আসো! পাখি যা বলে করো।

উঠোনে নামে নির্মলা। সবই টুকটুক করে দেখছে রাখালভোগায়। আঁচলের তলায় কন্ডোমের প্যাকেট। থমকে দাঁড়িয়ে সেটা পাখিকে দেখায় নির্মলা। পাখি আরও নিচু ডালে নেমে আসে।

Ñ যাঃ, পাগল! বলে উঠোন থেকে ঘরে যায় বউ। তারপর কন্ডোম বালিশের তলে রেখে দেয়।

নেমে আসে উঠোনে। রাখালভোগায় আনন্দে টই দেয়। চোখ উলটে আহ্লাদ করে। বউ বাইরে আসে। রাস্তায় পড়ে। রাস্তার পর বাগান। বাগান পেরিয়ে শস্যপ্রান্তর। আল ধরে এগিয়ে চলে বউ। একটি গাছ ছেড়ে আর একটি গাছে চলে গিয়ে নিচু ডালে নেমে এসে উড়ে যায়।

নির্মলার মনে হয়, পাখিটা তাকে ধরা দিতেই চাইছে। আশ্চর্য খেলা খেলছে।

Ñ আয়!

এগিয়ে আসে।

হাত বাড়ালেই সরে যায়।

Ñ আয়।

আবার আসে। আবার সরে যায়।

এই করে-করে এ কোথায় এনে ফেললে পাখিটা। আরও গভীরতর প্রান্তরে চলে আসে বউ। একটি বাগান পার হয়। দধিডাঙার বিল-লাগা বাগানে চলে এসেছে নির্মলা।

তার চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে মাধবজ্যাঠার করুণ দুটি চোখ। জীবনের প্রতি তাঁর যেন কোনও অভিযোগই নেই। চোখে জল এসেছিল ভয়ে। ক্ষোভে বা দুঃখে নয়। ভাবখানা যেন এই রকম: এই রকমই যদি হল, তাহলে মা, খাব কী? ছেলে তো বেকার। ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে!

বাগানের মাঝখানে একটি ছোট পুকুর। পুকুরপাড়ের আমগাছটায় অত্যন্ত নুয়ে থাকা ডালে রাখালভোগায় বসেছে।

Ñ এখানে কী, রাখালভোগায়?

পাখিটা যেন কথা বলার জন্য ছটফট করছে। পারছে না। কী মিষ্টি ওর স্বভাব।

Ñ আসো।

এগিয়ে এসে সরে যায়।

গাছের তলায়, পাড়ের নিচের ঢালে অর্থাৎ যে-দিকে জল তার উল্টোদিকের পাড়ের নিচে, জড়ের উপর একখানি বই। বইটির নাম ‘পল্লীসমাজ’। অবাক হয়ে হাতে নেয় নির্মলা।

ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে আসে আশ্চর্য এ নীল পালক। নির্মলা অবাক হয়ে দেখতে থাকে পালকটা। এমন সময় গাছের ওপিঠের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে সঞ্জয়।

Ñ কী দেখছ? বলে ওঠে।

চমকে ওঠে নির্মলা। পালক এক হাতে। অন্য হাতে বই। ধীরে ধীরে গাছের জড়ের পাটাতনে রেখে দেয় বই। তার উপর পালক। তারপর মনে হয়, এ এক আশ্চর্য জায়গায় এনেছে পাখিটা। তারপর পাখিটা কোথায় উড়ে চলে গেছে।

আজ কী হয় ওরা দু’জন বলতে পারে না। নির্মলার প্রথম কৌতূহল হয় তার বঞ্চিত প্রেমিকের ঠোঁটে চুম্বনের প্রতি। এ কি আলাদা! এ কি অন্য রকম! হঠাৎ এক তীব্র কামনায় নির্মলার শরীর কেঁপে ওঠে! সে সহসা এবং আচমকাই, এই গোপন শিকড়ে সঞ্জয়কে টানে। তারপর সঞ্জয়ের ওষ্ঠাধরে নিজের মুখ চেপে ধরে। নারীর চুম্বনের স্বাদ এই প্রথম পায় সঞ্জয়। সে জানে না, চুম্বন কতদূর যায়, কী তার শৈলী। নির্মলার ঠোঁট-অধর সবই শেখাতে থাকে এবং নির্মলার মনে হয়, কী নরম এই যুবক, কী সুগন্ধিত এই যুবকের পবিত্র দেহখানি, কী মধুর! লালু মোটে এ রকম নয়।

স্বামী তাকে চিৎ করে ফেলে আঘাত করেÑ এটিই তার এক ও অদ্বিতীয় মুদ্রা। আর আজ? নিজেই নগ্ন হয় সে, নিজে হাতে। তারপর উপগত হয় সঞ্জয়ের উপর। সে উপরে। সঞ্জয় নিচে। এই প্রথম বউ নিজেই বিশেষ অবাক হয়েছে, এ সে কী করছে! প্রতিটি সম্ভোগ-কনায় স্বর্গ নেমে আসে। আর চোখ বেয়ে জল নেমে আসে নির্মলার।

Ñ কন্ডোম ফেলে এলাম সঞ্জয়। স্বামীকে যা দিইনি, তোমাকে তাই দিলাম। আমার পবিত্রতা। আমার সব। আমি আর আস্ত ফিরব না। ওগো, আমাকে ক্ষমা করো!

বলতে বলতে বউয়ের শরীর স্বর্গের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকেÑ আশ্চর্য মেঘের মতো হালকা হয়ে যায়। এই প্রথম রাগমোচন করে নারী। নির্মলার অর্গাজম হয়।

তারপর রাখালভোগায় বউকে ফিরিয়ে নিয়ে চলে। বউয়ের কেশপাশে নীল পালক। পাখি দেখে গুলতি প্রস্তুত করে নবু। মারতে পারলে পঞ্চাশ টাকা ইনাম। ছেলের দলকে ভোগাতে থাকে পরণকথার পাখি।

---------
সূত্র: নতুনধারা: মে ২০১০

No comments: