Saturday, October 30, 2010

বা ড়ি ফে রা - সে লি না হো সে ন

পায়ের ঘা শুকোয় না কেন এ নিয়ে আছিরুদ্দীন তেমন চিন্তিত নয়। ও গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ, পায়ের ঘা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার সময় কোথায়? ভেবেছে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে। ছোটখাটো এমন কত কিছুই তো হয়। কিন্তু না, দিন গড়ায় কিন্তু ঘা শুকোয় না। একদিন আছিরুদ্দীন জায়গাটা চেপেচুপে দেখে ভড়কে যায়। বেশ টুপটুপে হয়েছে। রস ঝরছে। হঠাৎ মনে হয় ছোট্ট একটা পোকার মতো কিছু একটা হেঁটে বেড়াচ্ছে। ভয়ে আছিরুদ্দীনের বুক শুকিয়ে যায়। এ বড় অন্যায়। খেটে খাওয়া মানুষ বলে ঘায়ে পোকা হয়ে যেতে হবে? ও বাড়ির কাউকে কিছু বলে না।
 
কিন্তু বাদ সাধল বড় মেয়ে মেঘলা। আঠার বছর বয়স। ব্র্যাক স্কুলে পড়ে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। আছিরুদ্দীনের ধারণা, এই পড়ালেখার ফলে মেয়েটির যথেষ্ট জ্ঞানগম্যি হয়েছে। ও সরাসরি বলে, আব্বা এটা খুব খারাপ অসুখ।


 
_ তুই ক্যামনে জানলি মাগো?
_ এইটা তো সোজা হিসাব আব্বা। ঘা শুকায়ে ভালো হবে। যখন শুকাবে না তখন বুঝতে হবে খারাপ। এটা হলো গিয়ে আক্কেল।
_ সাবাস, লেখাপড়া দিয়ে আক্কেলই তো চেয়েছিলাম। বুঝলি মা আক্কেলটাই হলো বড় শিক্ষা। আমারও ইচ্ছা হয় তোর সঙ্গে স্কুলে যাই।

 
মেঘলা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। স্কুলে পড়ার গৌরব তার দৃষ্টিতে। কর্তৃত্বের সুরে বলে, স্কুলে পড়েই তো জানতে পারলাম ডায়রিয়া হলে কী করতে হবে। খোলা জায়গায় পায়খানা করলে কী হয়, পরিবেশ, পুষ্টি_
পাশ থেকে ওর মা বলে, হয়েছে থাম। গরিবের আবার এত কিছু। গরিবের কেবল আক্কেল থাকলেই হয়। তারপর স্বামীর দিকে ঘুরে বলে, ঘা থেকে গোন্ধ আসে।


পরদিন থানা সদর হাসপাতালে গেল আছিরুদ্দীন। সঙ্গে মেঘলা। দেখেশুনে ডাক্তার বললেন, মনে হচ্ছে ডায়াবেটিস আছে। এতদিন অবহেলা করা উচিত হয়নি। তোমাকে ঢাকা যেতে হবে। পাটা কেটে ফেলতেও হতে পারে।
_ ও বাবা গো! কি বলেন ডাক্তার সাহেব?
মেঘলা চেঁচামেচি করে।
আছিরুদ্দীন কাঁদে না, ভেঙেও পড়ে না, নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আমাগো টাকা কনে যে ঢাকা যাব?
_ টাকা না থাকলে, পাও থাকে না। যাও, বাড়ি যাও।
ডাক্তার অন্য রোগী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। মেঘলা একবার ডাক্তারের মুখের দিকে তাকায়, একবার হাতে ধরা প্রেসক্রিপশন দেখে। ডাক্তারের হাতের লেখাও পড়তে পারে না। ইংরেজিতে লেখা ওষুধের নাম ও পড়তে পারবে এতটা শিক্ষা ও পায়নি। নিজের ওপর রেগে গিয়ে তীক্ষষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ডাক্তার সাহেব ওষুধ কি হাসপাতালে আছে?
_ না। বাইরে থেকে কিনতে হবে।

 
ডাক্তারের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।
আছিরুদ্দীন স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার মুখে কথা নেই। যা কথা মেঘলাই বলছে। ওর পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে মেঘলাই বড়। চটপটে। আছিরুদ্দীনের ভাষায়, ভীষণ বুদ্ধি মেয়েটির। তারপর বড় করে শ্বাস টেনে বলে, মেয়েটা যদি আমার ছেলে হতো!
এ দীর্ঘশ্বাসের জবাব হয় না। মেঘলা এমন কথা শুনে আড়ালে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ছেলে হলে আপনের মুণ্ডুপাত করত। বাবাকে ও ভীষণ ভালোবাসে। তবে দুঃখে আঘাত দিতে চায় না। মায়ের ধারণা, মেয়ে হওয়াটা মস্ত অপরাধ। মেয়েদের বিয়ের ভাবনা ভাবতে হয়। মেঘলা মায়ের কথা শুনেও দাঁত কিড়মিড় করে বলে, আম্মা মনে হয় আপনে বিয়ের পর মেয়ে হয়েছেন। আপনের আব্বার কোনো ভাবনা ছিল না।

 
আছিরুদ্দীন মেয়ের জবাব শুনে হো হো করে হাসে। ওর মা রেগে তীব্র চোখে তাকায়।
মেঘলা তখনও ডাক্তারের টেবিলের সামনে থেকে নড়েনি। জিজ্ঞেস করে, এ ওষুধগুলো খাওয়া হলে আবার আপনার এখানে আসব ডাক্তার সাহেব?
_না। ব্লাড টেস্ট করাতে হবে। এখানে প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট নেই।

 
দু'জনে বাইরে আসে। ডাক্তারের জন্য একবেলা অপেক্ষা করতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, মর্জিমতো আসে আর যায়। তবু কপাল ভালো যে একবেলা বসে থেকে ডাক্তারের দেখা পেয়েছে। গাঁয়ে ফেরার বাস বিকেল ৫টায়। এখনও ঘণ্টা দেড়েক বাকি। আছিরুদ্দীন ক্লান্ত। খিদে পেয়েছে। মেঘলা মুড়ি কিনতে গেছে। আছিরুদ্দীনের বিমূঢ় ভাব কাটে না। ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছে। ও কী করে জানবে যে ওটা একটা ব্ল্যাকহোল, বেরুনোর সাধ্যি আর নেই।

 
মেঘলা মুড়ি নিয়ে এসে ডাকে, আব্বা?
আছিরুদ্দীন বলে, ব্যাঁ, ব্যাঁ।
মেঘলা আবার ডাকে, আব্বা?
আছিরুদ্দীনের শব্দ, হাম্বা, হাম্বা...।
মেঘলা তৃতীয়বার ডাকে, আব্বা? ও আব্বা?
_ ঘেউ ঘেউ।
_ আব্বা গো?
_ মিউ, মিউ।

 
মেঘলা বুঝে যায় যে আব্বা আর মানুষ নেই। গরিব মানুষের এত বড় কিছু হলে সে মানুষের আকৃতি হারিয়ে ফেলে। তার ভেতরের মানসিক বোধও থেঁতলে যায়। তখন সে ভেতরে এবং বাইরে বিভিন্ন আকার পায়। সেটা এতই অদৃশ্য যে তা দেখার জন্য বিশেষ চোখ লাগে। সবাই দেখতে পায় না। এই মুহূর্তে মেঘলা দেখতে পাচ্ছে। ওর বোধটি ভীষণ তীক্ষষ্ট। তাই ও বাবার ওপর রেগে যায়। মুড়ির ঠোঙাটা এগিয়ে দিয়ে বলে, খান, মুড়ি খান।

 
আছিরুদ্দীন এক মুঠি মুড়ি গালে পোরে। মুড়ি খাওয়া শেষ করে দু'জনে টিউবওয়েল চেপে পানি খেয়ে বাসস্ট্যান্ডে আসে। কখন বাস আসবে কে জানে, জায়গাটা প্রায় ফাঁকা। চারটে ছেলে রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছে। ওরা বড় একটি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। আছিরুদ্দীন মেয়ের কাঁধের ওপর হাত রাখে। চারদিকে ধুলোর আস্তর। গাছের পাতাগুলোর সবুজ বর্ণ বিবর্ণ হয়ে গেছে। হঠাৎ মেঘলা বাবাকে ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়, চলেন ওই ডাক্তারের মাথা ভাঙি।

 
আছিরুদ্দীন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বলে, ক্যান?
_ সরকার আমাদের জন্য ওষুধ দেয়। শুয়োরের বাচ্চা ওগুলো বেচে।
_ বেচবেই তো। ওদের যে অনেক দরকার।
আছিরুদ্দীনের পা টনটন করে। মনে হয় ঢাকা পর্যন্ত ওর আর যাওয়া হবে না। এই মেয়েটির ওপর সংসার রেখে মরতে হবে। মেয়েটি কীভাবে সংসার চালাবে? আছিরুদ্দীন আবার বিভিন্ন আকারে নিজের ভেতর প্রবেশ করতে থাকে। এখন আল্লাহ ছাড়া ওর আর কোনো ভরসা নেই। ওর জড়-জগৎ নিয়ন্ত্রণ করবেন রাব্বুল আলামিন।
মেঘলা নিজের ক্রোধ সামলে নিয়ে বলে, আব্বা আমাদের কী হবে?
_ শোকর কর মা। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
_ কিসের জন্য শোকর? আমরা কি পেলাম?
_ আমরা তো বেঁচে আছি মা।
_ কচু। বিষ খাওয়ার সময় হয়েছে।
_ তাও বল মা শোকর আলহামদুলিল্লাহ।

 
আছিরুদ্দীনের শোকর গোজারি শেষ হতে না হতেই সেই চারটি ছেলে গুলতানি ছেড়ে রাস্তার ওপারে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। আছিরুদ্দীন শক্ত করে মেঘলার হাত চেপে ধরে।
প্রথম ছেলেটি এক ঝটকায় আছিরুদ্দীনের হাতে টান দেয়, ছাড়, শুয়োরের বাচ্চা।
_ আপনারা কি চান?
_ চাই তোর মাইয়া। এইখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। এক পা লড়বি তো জান খতম করে ফেলব।

 
চারজনে মেঘলাকে টানতে টানতে ইটখোলার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। মেঘলা চেঁচিয়ে বলে, আব্বা বলেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
চারটি ছেলে হো হো করে হাসে। উচ্চহাসির রোলে চাপা পড়ে যায় মেঘলার চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে একজন পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর মুখ বেঁধে দেয়। ও একজনের হাত কামড়ে দেয়, অন্যজনের মুখ খামচিয়ে রক্ত বের করে ফেলে। ওইটুকুই। ব্যস, মেঘলার যুদ্ধ শেষ। ইটখোলার ইটের পাজার আড়ালে ওরা ওরই শাড়ি দিয়ে ইটের সঙ্গে ওর দু'হাত বেঁধে রাখে। তারপর একে একে... কতবার... মেঘলা মনে করতে পারে না। ও জ্ঞান হারায়।

 
কতকাল পর আছিরুদ্দীন দেখতে পায় বাস এসেছে। দু'চারজন যাত্রী নেমে যে যার পথে চলে যায়, আছিরুদ্দীন নড়ে না। চড়ে না। গোঙায় না। বসে থাকে। বসে না থেকে উপায় নেই। মৃত্যু ভয় নয়, ধর্ষণের দৃশ্যটি দেখার গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ও ছেলেগুলোর সামনে যেতে চায় না। এই মুহূর্তে এই গাছের গুঁড়িটি ওর সহায়। এখানে হেলান দিয়ে ও নিজেকে ধরে রাখতে পারছে।

 
কত রাত কে জানে, ছেলেগুলো চলে যায়। যাওয়ার সময় একজন ওর গায়ে লাত্থি দিয়ে বলে, মাইয়া লইয়া বাড়ি যা। আছিরুদ্দীন জানে, এই পথে আর কোনো বাস আসবে না। ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অন্ধকার হাতড়ে ইটখোলায় এসে পেঁৗছায়। ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত মেঘলা নিশ্চুপ বসে আছে। অন্ধকারে ওকে স্পষ্ট দেখা যায় না। এজন্য আছিরুদ্দীন আল্লাহর কাছে শোকর গোজারি করে। তারপর মেয়েকে ডাকে, মা?


_ব্যাঁ, ব্যাঁ।
_ মারে
_হাম্বা, হাম্বা।
_মাগো।
_ঘেউ ঘেউ।
আছিরুদ্দীন চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।

 
মেঘলা ধমক দেয়, কাঁদেন ক্যান? চুপ করেন। কন শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
আছিরুদ্দীন থামতে পারে না, বরং চরাচর ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে। মেঘলা নিঃশব্দে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা ইটগুলো সমান করে বিছায়। বাপের গায়ের চাদরটা ইটের ওপর পেতে দিয়ে বলে, ঘুমান আব্বা।

 
আছিরুদ্দীন শুয়ে পড়ে। মেঘলা বসে থাকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা শরীরে। আজ রাতে ওর আর ঘুম আসবে না। ও একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাওয়ার সময় একজন ফিসফিস করে বলেছে, রাতে তো তোর গাঁয়ে ফেরা হবে না। ভোর রাতে আবার আসব। এখন ঘুমুতে যাচ্ছি। এখানেই থাকিস।
মেঘলা এখন ভোররাতের অপেক্ষা।

 
ভোররাতের আধো অন্ধকারে ছেলেটি আসে। ঘুমজড়ানো চোখ। গুলতানি মারার ভঙ্গিতে মেঘলার কাছে বসে ওর গায়ে হাত দেওয়ার আগেই পাশে জড়ো করে রাখা ইট দিয়ে ছেলেটির মাথায় বাড়ি মারে। ছেলেটির মাথা ফাঁক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। ও টুকরো-টাকরা ইটের ফাঁকে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
ঘুম ভেঙে যায় আছিরুদ্দীনের। ধড়মড় করে উঠে বসে বেকুবের মতো বলে, কি করলি মা?
ও বাপের হাত ধরে টান দিয়ে দাঁড় করিযে দেয়। বলে, বাড়ি চলেন। বাস আসার সময় হয়েছে।
<><><>
সংগ্রহ: কালের খেয়া - ২৯.১০.১০

No comments: