Saturday, August 28, 2010

র ক ফে স্টি ভা ল - প্র চে ত গু প্ত

বামাচরণ কবিরাজ লেনে জরুরি মিটিং বসেছে। মিটিং-এ গলির বড়, মেজ, ছোট তিন প্রজন্মই হাজির। কত বছর পরে যে সকলে একসঙ্গে বসল, কেউ মনে করতে পারছে না। যদিও আলোচনা মোটেই শান্তিপূর্ণ হচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে, মিটিং তত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। উত্তপ্ত হয়ে ওঠারই কথা। ষোলো থেকে ছাব্বিশের স্লট অতি আশ্চর্য এবং উদ্ভট এক প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। গলির বড় এবং মেজ প্রজন্ম সেই প্রস্তাব শুনে আকাশ থেকে পড়েছে। এমনটা আবার হয় নাকি! হয়েছে কখনও? ষোলো থেকে বাইশের দল বলছে, না হয়নি। এটাই প্রথম হবে। বয়স্করা বলছে অসম্ভব। অর্থহীন। পাগলামি। ষোলো থেকে বাইশ বলছে, আমরা পাগলামিই করব। পাগলামি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব।
সত্যি পাগলামি। বামাচরণ কবিরাজ লেনের ছেলেমেয়ের দল ঠিক করেছে, এই বসন্তে তারা...।

ও-দিকে মিটিং চলুক। এই ফাঁকে বামাচরণ কবিরাজ লেনের একটু পরিচয় দেওয়া যাক। শান্তশিষ্ট, লাজুক ধরনের গলি। গলির মুখে বেঁটেখাটো একটি ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। জরাজীর্ণ বয়সের ভারে ক্লান্ত। এক সময় বলা হত, এটি নাকি ব্রিটিশ আমলের গ্যাসবাতি। তথ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও জিনিসটি নিয়ে গলির বাসিন্দাদের চাপা গর্ব ছিল। বহু বছর আগে এক বার চাঁদা তুলে রংও করা হয়েছিল। কালচে সবুজ। রং নিয়ে আপত্তি উঠলে বৃদ্ধরা চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, বেশি বোকো না হে। ব্রিটিশ আমলে এমনটাই নিয়ম ছিল। জিনিস যখন তাদের, নিয়মও তাদের মতো হবে। দীর্ঘ অযত্ন, অবহেলায় সেই ল্যাম্পপোস্টে মরচে পড়েছে। বাইরের ল্যাম্পপোস্টটি (মতান্তরে গ্যাসবাতি) নড়বড়ে হয়ে গেলেও, গলির ভেতরের সারি সারি বাড়ি এখনও খুবই শক্তসমর্থ। দোতলা, তিন তলা, সাড়ে তিন তলা। একটার ঘাড়ে আর একটা। ছাদে ছাদে বাটিচচ্চড়ি, পোস্তোর বড়া, চিংড়িমাছের মালাইকারি আর ভুল বানানে তোমরি বিরহে কাঁদে মম প্রাণ লেখা প্রেমপত্র চালাচালির চমৎকার সিস্টেম ছিল। দুপুরে কার্নিশে বসে ঝিম ধরা গলায় পায়রা ডাকত, বিকেলে গলির সরু আকাশে পেটকাটি, চাঁদিয়ালে প্যাঁচ চলত প্রবলবিক্রমে। ব্যাকগ্রাউণ্ডে শাঁখের আওয়াজ নিয়ে সন্ধের পর ঘরে ঘরে হলুদ বাল্‌ব জ্বলে উঠত।
ছেলেমেয়েরা নামতা মুখস্থ করত গলা ফাটিয়ে। ভেসে আসত রান্নার ছ্যাঁকছোক। এখন কোথায় বাটিচচ্চড়ি? কোথায় পেটকাটি চাঁদিয়াল? কোথায় বা টিমটিমে হলুদ আলো? সব পাল্টে গেছে। আজ ঘরে ঘরে চাপা গলায় টিভি খবর বলে, চিৎকার করে ইণ্ডিয়ান আইডল খোঁজে। মাইক্রোওভেনে চিকেন বা পমফ্লেট মাছ শুয়ে থাকে পরমানন্দে, রোস্ট হয় চুপিচুপি। গভীর রাতে বামাচরণ কবিরাজ লেনের কিশোর ল্যাপটপে প্রেম চালায় নর্থ ক্যারোলিনাবাসী চিনা তরুণীর সঙ্গে। ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্সের খবর জেনে নার্ভাস হাতে কপালের ঘাম মোছে।


তবে সব পাল্টায়নি। কিছু জিনিস রয়েছে একই রকম। সেই বাড়ি, সেই ছাদ যেমন আছে, তেমনই আছে রোয়াক। রোগা, মোটা, লম্বা, বেঁটে নানা চেহারায়, নানা সাইজে। প্রতিটা বাড়ির নিচে ঝকঝকে তকতকে হয়ে শুয়ে আছে চিৎপটাং হয়ে। কোনোটা লাল, কোনোটা ধূসর। কোনোটায় শখ করে পাথরের টুকরো বসানো। প্রপিতামহের শখ ছিল। এখন একাকী থাকলেও বছরের পর বছর এই সব রোয়াক বামাচরণ কবিরাজ লেনের বাসিন্দাদের দুরন্ত সার্ভিস দিয়েছে। সকালে খবরের কাগজ আর চায়ের ভাঁড় সহযোগে রাজনীতির রাজা-উজিররা ধরাশায়ী হয়েছে পটাপট।
 কত বার যে এই গলির আলোচনায় গভর্নমেন্টের পতন হয়েছে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। সরকার ফেলেই সবাই ছুটেছে অফিসের জন্য তৈরি হতে। শীতের দুপুরে রকের দখল থাকত মহিলাদের কব্জায়। উল কাঁটা হাতে নেমে আসতেন তাঁরা। রোদে পিঠ রেখে দুটো সোজা একটা উল্টোর জটিল নকশায় ঢুকতে ঢুকতে গভীর আনন্দে উত্তম-সুচিত্রা আর পরচর্চায় ডুব দিতেন। বিকেলে রোদ পড়লে বৃদ্ধদের বৈঠকখানা সেজে স্মৃতিকথা শুনতে হত এই রোয়াককেই। শুনতে শুনতে তারাও বিশ্বাস করত, আহা, এক পয়সার যুগ কত ভালই না ছিল!
 দুধ টু চোনা সব খাঁটি ছিল। সন্ধের পর অফিস ফেরত বাবুরা বড় বড় কড়া নেড়ে বাড়ি ঢোকার আগে এই রোয়াকেই ক্যাম্বিসের ব্যাগ আর ছাতা ফেলে গোল মিস করা মোহনবাগানের গুষ্টির তুষ্টি করতেন গলা খুলে। তারা জায়গা ছাড়লে ছেলে ছোকরারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দখল নিত গোটা রোয়াক সাম্রাজ্য। এ বাড়ির দোতলা, ও বাড়ির আড়াই তলা থেকে ছিটকে আসা আবছা আলোয় আলু কাবলি, ঘুগনি সহযোগে পলিটিক্স থেকে দুর্গা পুজোর প্ল্যান, ফুটবল থেকে কাব্যচর্চার ঝড় উঠত। হাতের মুঠোয় লুকিয়ে জ্বলত বিড়ি-সিগারেটের আগুন। ও-পাশের তিন তলা থেকে মিত্তির জেঠিমা, এ পাশের দোতলা থেকে কাকিমা দেখে না ফেলে। মাঝে মাঝে পটলা বা গোবিন্দ ঠোঁটে আঙুল রেখে বলত শ্‌ শ্‌ শ্‌। ত্রস্ত পায়ে চলে যাওয়া অচেনা কিশোরীকে দেখে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠত কে তুমি নন্দিনী? আগে তো দেখিনি... বামাচরণ কবিরাজ লেনের রোয়াক গার্জেন সেজে চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়েছে কত বার। অ্যাই বাঁদর ছেলে। রকবাজের দল সব। হচ্ছেটা কী? বাড়ি গিয়ে পড়তে বস। দুর্ভাগ্যের বিষয় ধমক শোনা যেত না। গান চলত।

রকের এই রমরমা চুকেবুকে গেছে অনেক কাল। বামাচরণ কবিরাজ লেনের রক আজও আছে, কিন্তু সেখানে বসার মানুষ নেই। দিনরাত খাঁ খাঁ করে। বৈশাখ মাসের রোদে কখনওসখনও সেল্‌সম্যানের দল জিরিয়ে নেয় ছায়ায়। কাগজের বাক্স থেকে শুকনো স্যাণ্ডউইচ বের করে চিবিয়ে লাঞ্চ সারে। বোতল থেকে জল খায়। বৃষ্টিতে গলি জলে থইথই করলে, নেড়ি কুকুর সেখানে উঠে লেজ গুটিয়ে উদাসীন মুখে শুয়ে পড়ে। ভাবটা এমন যেন, সবই মায়ের খেলা। আজ আছে কাল নেই। সকালে স্কুলের বাস ধরতে এসে খুদে খুদে ছেলেমেয়েরা বিশ-মনি ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখে এই রোয়াকেই। রাইমস মুখস্থ করে ঘুম ঘুম চোখে। বাকি সময়গুলো শুনশান।

বামাচরণ কবিরাজ লেনের ছেলে-ছোকরার দল তাদের গলি এই রোয়াক নিয়েই হঠাৎ মেতেছে! প্ল্যান করেছে, সামনের বসন্তে হবে অনুষ্ঠান!

বদ্যিনাথ চট্যোপাধ্যায় গলির প্রাচীনতম বাসিন্দা। ছিয়াশিতে পা দেবেন দেবেন করছেন। মিটিঙের মাঝখানে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, গলির রোয়াকে আবার অনুষ্ঠান কী বাছারা! আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।

কলেজে অঙ্কুরের সেকেণ্ড ইয়ার চলছে। সে গলা তুলে বলল, এখনই বোঝার কিছু নেই দাদু। প্রোগ্রাম হলে দেখবেন।

শীলবাবু সরকারি অফিসের সেকশন অফিসার। সহজে ফাইল ছাড়া ধাতে নেই। চশমা তুলে বললেন, মজা হবে কী করে বুঝলে? তোমাদের প্ল্যান-প্রোগ্রাম তো কিছুই বলছ না। মজার বদলে দুঃখও তো হতে পারে। পারে না?

ঋষভ হোটেল ম্যানেজমেন্টের ফাইনালে দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতেই তিন-তিনটে চাকরির অফার এসেছে। একটাও নেয়নি। সে ফিল্মমেকার হতে চায়। শুরু করবে ডকুমেন্টারি দিয়ে। প্রথম কাজ কলকাতার গলি। গলির কলকাতা। স্বাভাবিক কারণেই তার উৎসাহ খুব বেশি। মাথা খাটিয়ে অনুষ্ঠানে বেশ কিছু আইটেম ঢুকিয়েছে। সে বলল, এক বার আমাদের হাতে ছেড়েই দেখুন না কাকু।

বিমল কাশ্যপ ব্যবসায়ী মানুষ। লাভ-ক্ষতি ছাড়া কোনও কিছু নিয়ে মাথা ঘামানো তাঁর পছন্দ নয়। বিরক্ত গলায় বললেন, সামান্য রোয়াক নিয়ে তোমরা হঠাৎ খেপে উঠলে কেন বুঝতে পারছি না। একটা সময় এ সবের কদর ছিল। আমরা তোমাদের বয়সে ওখানে বসে গুলতানি দিয়েছি। সে-সব তো এখন উঠে গেছে।

বিমলবাবুর কন্যা রাই। সে জিন্‌স পরে থাকার কারণে ফরাসে বসে কথা বলতে পারছে না। বসেছে জানলার গায়ে। এক হাতে জানলার রড ধরে ঝগড়া ঝগড়া গলায় বলল, রকে বসে গুলতানির যুগ শেষ বাপি। বাট স্টিল উই হ্যাভ দ্য রকস। ওরা এখনও আছে। কলকাতার গলি থেকে তো সেগুলো আর ছেঁটে ফেলা যাবে না। আসলে এই অনুষ্ঠানটা করে আমরা একটা ট্রেণ্ড সেট করতে চাইছি। একটা এগজাম্পেল বলতে পারো। এক্সপেরিমেন্টাল। ভাল বাংলায় পরীক্ষামূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন।

কীসের দৃষ্টান্ত?

কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার উৎসব উত্তেজিত গলায় বলল, এই সময়ের ছেলেমেয়েরা কী ভাবে রক ইউজ করতে পারে, সেই দৃষ্টান্ত। আমরা শিয়োর, জিনিসটা ঠিকমত করতে পারলে, চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়বে। অন্য পাড়াতেও এ ধরনের অনুষ্ঠান শুরু হবে। রক সেলিব্রেশন। মে বি কম্পিটিশনও হতে পারে। দিব্যজ্যোতি সেন কলেজের প্রিন্সিপাল। সব সময় ভুরু কুঁচকে থাকা সম্ভবত তাঁর চাকরির শর্তের মধ্যে পড়ে। এ কথা শুনে তিনি ভুরুর সঙ্গে চোখ-মুখও কোঁচকালেন। বললেন, এত কিছু থাকতে রোয়াক নিয়ে কম্পিটিশন! তোমরা হলটল ভাড়া নিয়ে নাচগান করো না। নাটকও করতে পারো। যদি চাও সেমিনার হোক। ধরো বিষয় হল, তরুণ প্রজন্মের হাতেই দেশের ভার তুলে দেওয়া উচিত। আমাকে যদি খুব চাপাচাপি করো, তা হলে আমিও বলতে পারি। কী খুব খারাপ হবে?

রাজন্যা আজকাল যেখানেই যায় সঙ্গে ল্যাপটপ রাখে। অর্কুটে বকবক না করলে তার চলে না। মিটিঙে এসেও করছে। দেওয়ালে পিঠ ছড়িয়ে বসেছে। কোলের ওপর ল্যাপটপ। সে এখন কথা বলছে, হায়দরাবাদের ই-ফ্রেণ্ডের সঙ্গে। স্ক্রিন থেকে মুখ না তুলেই বলল, সেমিনার করলে আপনাকে ভেরিমাচ বলব সেনজেঠু। তবে দেশের বদলে আপাতত এই বামাচরণ কবিরাজ লেনের রকের ভার তরুণ প্রজন্মের হাতে আপনারা ছেড়ে দিন। তা হলে খুবই ভাল হয়।

দিব্যজ্যোতি সেনের ইচ্ছে করল রাজন্যা মেয়েটিকে জোর গলায় একটা ধমক দেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। রাজন্যা তার কলেজের ছাত্রী নয়। প্রতিবেশী কন্যা। তিনি গলা খাকারি দিলেন। এই জন্যই তিনি যে কোনও জায়গায় আসতে চান না। নেহাত বিষয়টা গুরুতর। গলির ভেতর একটা হুজুগ হবে আর তিনি চুপ করে বসে থাকবেন, সেটা তো হয় না। কিন্তু এর পর আর কথা বলা অর্থহীন। আজকালকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এটাই সমস্যা। কথা বললেন তপন পালিত। মাথার কাঁচাপাকা চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, তোমাদের প্ল্যানটা কী জানতে পারি?

রবিবার সকালটা অর্ক তার ব্যাণ্ডের রিহার্সাল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ব্যাণ্ডের নাম শক থেরাপি। জটিল কিছু ফিউশন আছে। সেই শক থেরাপির রিহার্সাল বাদ তাকে মিটিঙে আসতে হয়েছে। কিছু করার নেই। রোয়াক অনুষ্ঠানের সে এক জন অন্যতম প্রস্তাবক। এক সপ্তাহ জুড়ে গোপনে মোবাইলে, মেলে পরিকল্পনা নিয়ে সকলের সঙ্গে কনফারেন্স-এ হয়েছে। ফাইনাল অ্যাপ্রুভালের দিন না থাকলে চলবে কেন? সে বলল, প্ল্যান খুবই জমজমাট তপনদা। থ্রি ডেজ ফেস্টিভাল।

গায়ত্রীদেবী আঁতকে উঠে বললেন, তিন দিন! সিঞ্চন ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে চণ্ডীগড়ে পড়তে গিয়েছিল। কোর্স শেষ করে দিন কতক হল বাড়িতে ফিরেছে। ফিরেই হইচইতে ঢুকে পড়েছে। কলকাতায় জন্মালেও এই গলিতে তার কখনওই একটানা বেশি দিন থাকা হয়নি। একটু বড় হওয়ার পরপরই হস্টেলে হস্টেলে কেটেছে। তবে বামাচরণ কবিরাজ লেন সম্পর্কে ভেতরে একটা টান আছে। ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনছে। গ্যাস বাতি রং করা থেকে রকে বসে রাজাউজির মারা সবই। উত্তেজিত গলায় সে বলল, শুধু তিন দিন নয় মা। আমরা ভেবেছি, শেষের দিন হোল নাইট টানব।

সুনন্দা পাকড়াশি রাগী মহিলা। চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ! সারারাত?
রণিত সামলানোর গলায় বলল, ঠিক আছে হোল নাইটটা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু প্লিজ আমাদের বাধা দেবেন না। এটা হবে আ ট্রিউব টু আওয়ার বিলাভেড রকস। প্রিয় রোয়াকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা। একটা সময় এরা তো কম সার্ভিস দেয়নি।
অসম্ভব। ইমপসিবল।

বৃদ্ধ বদ্যিনাথ চট্টোপাধ্যায় আবার তার কাঁপা কাঁপা হাত তুললেন। বললেন, আহা, ছেলেমেয়েরা যখন বলছে রাজি হয়েই দেখো না। যতই হোক নিজেদের গলিকে ভালবেসেই তো বলছে... আমারও কত কথা মনে পড়ছে... এক বার কী হয়েছিল জানো, আমি আর বিভূতি বসেছিলাম মিত্তিরদের রোয়াকে, সন্ধে হয় হয়... আমি বামাচরণ কবিরাজ লেনের সব থেকে বুড়ো মানুষ, এই গলির সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমার একটা হক আছে। যাও বাছারা, আমি তোমাদের পারমিশন দিয়ে দিলাম। ষোলো থেকে বাইশের দল হাততালি দিয়ে উঠল। বদ্যিনাথ মাথা নেড়ে বললেন, তবে একটা শর্ত।
কী শর্ত?
যা-ই করো বাপু, তোমাদের এই রোয়াক নিয়েই করতে হবে কিন্তু। দেখি তোমাদের ক্ষমতা।

ছেলেমেয়েরা ক্ষমতা সত্যি দেখিয়ে দিয়েছে। তাক লাগিয়ে দিয়েছে একেবারে। সন্ধের পর আলোয় ঝলমল করছে বামাচরণ কবিরাজ লেন। উৎসবের নাম হয়েছে রক ফেস্টিভাল। মিত্তিরদের রকে বসেছে রক ব্যাণ্ডের আসর। অর্ক সেখানে ভীষণ ব্যস্ত। ড্রামস আর সিন্থেসাইজারে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে। চাট্টুজ্জ্যেদের রকে সাজানো হয়েছে রক কাফে। পিৎজা, চিকেন অ্যাসপারাগাসের সঙ্গে পিঠেপুলি এবং আলুকাবলি পাওয়া যাচ্ছে। আলুকাবলিতে তেঁতুল জল। ফুট কোয়ালিটির ওপর কড়া নজর রেখেছে ঋষভ। শীলবাবু রোয়াক ছেড়েছেন চ্যাট কর্নারের জন্য। নাম হয়েছে রক চ্যাট। খান তিনেক কম্পিউটার চলছে সারাক্ষণ। রাজন্যা ইনচার্জ। সেনকাকুদের রোয়াক বেশ খানিকটা চওড়া বলে সেখানে আটটার পর শুরু হচ্ছে ফ্যাশন শো। রক ফ্যাশন। ধুতি-পাঞ্জাবি, শাড়ি, জিন্‌স, টপ আর কুর্তা সালোয়ার পরে রক-র‍্যাম্পে শো চলছে বাজনার তালে তালে। জামদানি পরে সেজেগুজে হাঁটতে গিয়ে বাহান্ন বছরের গায়ত্রীদেবী পা পিছলেছেন সামান্য। হাসির তুফান উঠেছে। মজার ব্যাপার গায়ত্রীদেবীও সেই হাসিতে যোগ দিয়েছেন! প্রিন্সিপাল দিব্যজ্যোতিবাবুর রোয়াকে চেয়ার-টেবিল পেতে কেরিয়ার গাইডেন্সের ওয়ার্কশপ খোলা হয়েছে। মাথার ওপর ব্যানার ঝুলিয়ে লেখা হয়েছে রক কেরিয়ার। দিব্যজ্যোতিবাবু কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে গম্ভীর মুখে ছেলেমেয়েদের কেরিয়ার বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রথম দিন ওয়েব পেজ ডিজাইন সম্পর্কে একটি কিশোর জানতে এলে, তিনি খানিকটা সমস্যায় পড়েন। বৃদ্ধ বদ্যিনাথ চট্টোপাধ্যায় খুবই আহ্লাদিত। আহ্লাদিত হওয়ারই কথা। উৎসব কমিটির ছেলেমেয়েরা তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছে। এই খবর তারা গোপন রেখেছিল। তাকে দেওয়া হয়েছে রক মাস্টার খেতাব।

তিনি বিকেলের পর থেকেই ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাসি হাসি মুখে উৎসব চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন লাঠি হাতে। একেবারে খুদে ছেলেমেয়েদের জন্য নিজের বাড়ির রোয়াক ছেড়ে দিয়েছেন রাগী সুনন্দা পাকড়াশি। এই ইভেন্টের দায়িত্বে রণিত। ইভেন্টের নাম ফিউচার-রকস্টার। ফিউচার রকস্টাররা যদিও তাদের ফিউচার নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। তারা বেদম ছোটাছুটি করছে। রকের ওপর হাততালি সহযোগে লাফালাফি করে গাইছে মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব।

খবর আরও দুটি আছে। এক নম্বর খবর হল, গলির মুখের ল্যাম্পপোস্টে (মতান্তরে ব্রিটিশ আমলের গ্যাসবাতি) রং পড়েছে। কালচে সবুজ রং। আর দ্বিতীয় খবরটি হল, কলকাতার বহু গলি এবং উপ-গলির বাসিন্দারা এই উৎসবটি চাক্ষুস দেখতে চাইছেন। তাদের একাকী, নিশ্চুপ পড়ে থাকা রকগুলিতেও যদি এ রকম কিছু করা যায়।

কোনও অসুবিধে নেই। বামাচরণ কবিরাজ লেনে যাওয়া কঠিন কিছু ব্যাপার নয়। সুকিয়া ষ্ট্রিটের মোড়ে নেমে, গড়পাড় রোডকে বাঁ হাতে রেখে...।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী

No comments: