ঝকঝকে প্রিমিও কড়া ব্রেক করল। রাস্তার কিনারায় থেমে দাঁড়িয়ে দুলছে, এমনি সময়ে
জানালার পাশে এসে দাঁড়াল দুই তরুণ, হাতে বই। দু জনেই ধোপদুরস্ত, রুচিসম্মত পোশাক
পরা, বয়স সতেরো কি আঠারো।
‘একটা লিফট চাইছিলাম, স্যর,’ শক্তপোক্ত চেহারার ছেলেটা বলল বিনীত ভঙ্গিতে।
‘কোথায় যাবে?’ প্রশ্ন করল
চালক। টাইটা একটু আলগা করল বাম হাতে। ‘কতদূর?’
‘গাজিপুরের দিকে, স্যর। পিকনিক স্পটে। স্কুল-পিকনিক। আমরা স্কুলে গিয়ে দেখি বাস চলে গেছে আগেই। আমাদের সামনে কোথাও নামিয়ে দিলেই হবে।’
‘কোন স্কুলে পড়ো তোমরা?’
‘গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে।’
অবাক হলো চালক। ‘পিকনিকে যাবে, বিকেল গড়িয়ে তো সন্ধে হতে চলল... এই অসময়ে উত্তরায় কী করছ?’
‘এক ভদ্রলোক আমাদের এ-পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ডানদিকে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছি,
স্যর।’
‘উঠে পড়ো। আমি মাইমেনসিং যাচ্ছি, নামিয়ে দিতে পারব।
তবে বুঝে দেখো
বাপু, এখন গিয়ে কিন্তু খাওয়া পাবে না—বড় জোর খালি পেটে ফিরে আসতে পারবে বন্ধুদের সাথে।’
‘খাওয়া মিস্ করেছি,’ বলল
স্বাস্থ্যবান তরুণ, ‘কিন্তু অনুষ্ঠানটা মিস্ করতে চাই না স্যর।’ বুড়ো
আঙুল দিয়ে পাশের ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করল। ‘ওর গান গাওয়ার
কথা আছে, আমি বাজাব গিটার। তা-ই না, মিলন?’
‘হুঁ।’
প্রথম জন উঠল চালকের পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে। ওর সঙ্গী, ছোটখাটো, নরমসরম, মেয়েলি চেহারার মিলন উঠল পেছনের সিটে। নুড়িপাথরের ওপর খড়মড় আওয়াজ
তুলে সামান্য স্কিড করে রাস্তায় উঠে চলতে শুরু করল প্রিমিও।
‘তোমার নাম মিলন বুঝি?’ ত্রিশোর্ধ্ব
চালক জিজ্ঞেস করল। ‘আমিও মিলন,
জারিফ আহমেদ
মিলন।’ রাস্তার ওপর থেকে পলকের জন্য চোখ সরিয়ে চাইল গিটারিস্টের দিকে ‘আর তোমার?’
‘শাহেদ।’
‘কোন ক্লাস?’
‘টেনে উঠলাম এবার।’
‘গুড।’
অনেকক্ষণ চুপচাপ। সবাই নিজ নিজ
ভাবনায় ডুবে আছে। জয়দেবপুর পৌঁছে ডানে-বাঁয়ে না গিয়ে সোজা
রাস্তা ধরল গাড়ি। এদিকে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হতে
চলেছে। জারিফ বলল, ‘আমার তো ভয়
হচ্ছে, কেবল খাওয়া না, অনুষ্ঠানটাও
তোমরা মিস্ করতে চলেছ।’
কয়েকটা পিকনিক-বাস দেখা গেল, ফিরে যাচ্ছে
ঢাকায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর প্রথম পিকনিক স্পটটা পড়ল ডানে। মাথা নাড়ল শাহেদ—এটা না, আরো আগে। দ্রুত আঁধার হয়ে আসছে চারদিক,
দু পাশে
গাছপালার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জঙ্গল আরো ঘন দেখাচ্ছে। সামনে থেকে আসা বেশকিছু গাড়ি লাইট জ্বেলেছে।
প্রিমিওর সাইড লাইট জ্বালল জারিফ, বলল, ‘এই রকম
আলো-আঁধারির সময়টাতেই বড় বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়। গোধূলির আলো ধাঁধা লাগিয়ে দেয় চোখে, দূরত্বের আন্দাজ
ঠিক থাকে না।... তোমাদের পিকনিক স্পট আর কতদূর?’
‘এই তো সামনে,’ বলল শাহেদ।
‘চেনো মনে হচ্ছে? আগেও এসেছ বুঝি?’
‘হ্যাঁ, এই তো ক দিন আগেই।
তাই না, মিলন?’
জবাবে কাশির মতো একটা শব্দ করল পেছনে বসা গায়ক।
মাইলখানেক পর ডানদিকে সরু একটা প্রায়-আঁধার রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করল
শাহেদ, ‘এই দিকে।’
ব্রেক কষল জারিফ। দু পাশে সার
দিয়ে বোনা শালগাছের ভেতর দিয়ে কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিয়েছে রাস্তাটা।
‘এইখানে? এটা তো কোনো...’ ছেলেদুটোর মধ্যে নামার কোনো লক্ষণ না দেখে থেমে গেল জারিফ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শাহেদের দিকে।
‘ভেতরে চলুন,’ বলল সে।
‘এখানেই নেমে পড়ো,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল
জারিফ। ‘এই পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি, ব্যস্... নামো এবার।’
‘ভেতরে চলুন বলছি!’ ধমকে উঠল শাহেদ।
চমকে উঠে জারিফ দেখল, ছেলেটার বাম
হাতে আধ হাত লম্বা বিকটদর্শন একটা ছোরা। পরমুহূর্তে বেশ জোরের সঙ্গেই ঠেকাল সে ওটা ওর
পাঁজরে। তীক্ষ, সুচালো ডগাটা স্পোর্টস জ্যাকেট ছিদ্র করে ঢুকতে চাইছে ভেতরে।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ বাঁক নেবার জন্য স্টিয়ারিং হুইলটা ঘোরাল
জারিফ। পাঁচ টাকার কয়েনের সমান হয়ে গেছে চোখ। ‘যাচ্ছি ভেতরে। ব্যথা দিয়ো না আমাকে, প্লিজ!’
গলিতে ঢুকে বামে বাঁক নিয়ে দশ গজ যেতেই থামার নির্দেশ দিল শাহেদ। বড়সড় একটা ঝোপের ধারে গাড়ি থামিয়ে ওর দিকে ফিরল জারিফ। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাও তোমরা আসলে? গাড়িটা? গাড়িটা চাও? ঠিক আছে নিয়ে যাও এটা। এই যে চাবি,’ ইগনিশন থেকে চাবি বের করে ছেলেটার দিকে
বাড়িয়ে ধরল, ‘নাও। আমি... আমি
স্বেচ্ছায় নেমে যাচ্ছি।
প্লিজ...
প্লি-ই-জ জখম কোরো না আমাকে।’
‘গাড়ি চাই না আমরা,’ শীতল কণ্ঠে বলল
শাহেদ।
‘তা হলে? তা হলে কী চাও?’
‘ডেলিঙ্কুয়েন্টরা যা চায়... কিক!’
‘বুঝলাম না।’
‘কিক বুঝলেন না? কোন যুগের মানুষ! ...নতুন কিছু, বুঝলেন? আমোদ, ফুর্তি। কাগজে পড়েননি, অ্যাডোলেসেন্ট
টিন এজাররা আজকাল আর গাঁজা-ফেন্সিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না; নিত্য-নতুন উপায় খুঁজে নিচ্ছে বিনোদনের? আমরাও চরম বিরক্ত
হয়ে উঠেছি ওসব
নেশায়। তাই আমি আর মিলন ঠিক করেছি—একটা মানুষ খুন করে দেখব কেমন লাগে। তা-ই না, মিলন?’
পেছনে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে মিলন, জবাব দিল না।
চোখ গরম করে ওর দিকে চাইল শাহেদ। ‘কী হলো? মুখে রা নেই কেন? কথার জবাব দিচ্ছ না যে? ভয় পেয়ে গেলে নাকি? এতদিন প্ল্যান করার পর আজ সত্যি সত্যিই এ
পর্যন্ত চলে এসেছি—এই লোকটাকে খুন করব আমরা। তুমি আর আমি! শেষ মুহূর্তে এখন তো আর
পিছু হটলে চলবে না, দোস্ত!’
‘শোনো,’ কথা শুনে আত্মা চমকে গেছে জারিফের, বলল, ‘টাকার জন্যে তো? টাকা চাই? হাজার খানেক দিচ্ছি। তোমরা দুই বন্ধু অনেক আমোদ-ফুর্তি করতে পারবে এই টাকায়। না হয় পাঁচ হাজার দেব। আমি...’
‘টাকা চাই না আমরা!’ বাধা দিল শাহেদ।
‘টাকার অভাব নেই আমাদের।’ বুড়ো আঙুল দিয়ে
দেখাল পেছনে। ‘বিশেষ করে ওর—কয়েক শ কোটি টাকা আছে ওর বাপের। তা-ই না, মিলন? নামি-দামি
ব্যারিস্টার উনি, এক ডাকে চেনে দেশের সবাই। নাম বললে আপনিও হয়তো চিনতে পারবেন। ব্যা...’
‘অ্যাই, কী হচ্ছে!’ চেঁচিয়ে উঠল আতঙ্কিত মিলন। ‘চুপ করো! আমাকে কথায় কথায় পটিয়ে রাজি
করিয়েছ একাজে, এখন আবার আমার আব্বাকেও জড়িয়ো না এসব
জঘন্য, নোংরা,
বীভত্স
ব্যাপারে।’
‘হ্যাঁ,’ বলল শাহেদ, ‘আমিই বলে-কয়ে
রাজি করিয়েছি তোমাকে এই কাজে ঠিক;
কিন্তু এখন তো
জড়িয়েই গেছো, দোস্ত। এখন আর ফেরার উপায় নেই। বুঝতে পারছ
না... এই ব্যাটাকে যদি খুন না করে ছেড়ে দিই আমরা এখন, সোজা গিয়ে হাজির হবে থানায়। মহাবিপদে ফেলে
দেবে আমাদের। তখন ব্যারিস্টার আশ...’
‘না, না, কাউকে একটা কথাও বলব না আমি,’ কাতর কণ্ঠে বলে
উঠল জারিফ। ‘কী করে বিপদে ফেলব, তোমাদের কারো
পুরো নামই তো জানি না আমি।’
‘মিথ্যে কথা!’ গর্জে উঠল শাহেদ।
‘আপনি জানেন আমার নাম শাহেদ আসলাম। জানেন ওর নাম মিলন মাহমুদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডাকসেটে ব্যারিস্টার আশরাফ মাহমুদের একমাত্র সন্তান।’
‘এসব ওকে বলে দিলে কেন!’ মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে শুরু করল মিলন, ‘কেন ওকে জানিয়ে দিলে সব?’
‘বি আ ম্যান, মিলন!’
ধমক মারল শাহেদ। ‘মুরগির বাচ্চার মতো চিঁ-চিঁ কোরো না তো! তোমার ভাবসাব দেখেই বলে দিতে বাধ্য
হলাম—তুমি যাতে শেষ মুহূর্তে ব্যাক-আউট করতে
না পারো। তাছাড়া আমি না হয় ড্রপ আউট, লেখাপড়া ছেড়ে মস্তানি করে বেড়াই; কিন্তু ও জানে
কোন স্কুলের কোন ক্লাসে পড়ো তুমি।’
‘কিন্তু...’
‘আবার কিসের কিন্তু? আর কোনো কিন্তু নেই, দোস্ত। তোমার আব্বাকে ভালোমতোই চেনে ও, ভুলেও ভেবো না ওকে ছেড়ে দিলে কাউকে কিচ্ছু বলবে না। আর কোনো উপায় নেই মিলন, ওকে এখন আমাদের খুন করতেই হবে।’
‘না!’
ফোঁপাতে শুরু
করল জারিফ আহমেদ।
‘প্লিজ, মেরো না আমাকে! প্লিজ!’
উন্মাদের মতো খিক খিক করে হেসে উঠল শাহেদ, আরো একটু চাপ দিল ছোরায়।
‘চেঁচাও, যত জোরে খুশি!’ খলনায়কের ভঙ্গিতে বলল সে, ‘কেঁদে বুক ভাসাও, কাকুতি-মিনতি করো! পায়ে পড়ে প্রাণ ভিক্ষা
চাও, থর থর করে কাঁপো ভয়ে!’ হাসল আবার। ‘এসব দেখব আর শুনব বলেই তো খুন করছি তোমাকে। জবাই করার আগে প্রথমে চার হাত-পা কেটে আলাদা করব, তারপর মাটিতে পেড়ে ধরে ধীরে ধীরে পোচ
মারব গলায়, কোরবানির খাসির মতো গোঙাবে তুমি; কিন্তু মিলন, শুরুটা কিভাবে করা যায় বলো তো?’ একহাতে জারিফের চুল চেপে ধরল সে। ‘আগে ওর গলাটা সামান্য ফেড়ে খানিক রক্ত ঝরিয়ে নেব? নাকি ছোরাটা ওর পেটে
ঢুকিয়ে এদিক
ওদিক ঘুরিয়ে গোটাকয়েক নাড়ি-ভুঁড়ি কেটে দেখব রগড়?’
হাউমাউ করে উঠল জারিফ।
‘কী হলো!’ মিলনের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে কটমট করে চাইল শাহেদ ওর দিকে।
দু হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাচ্ছে মিলন, চোখ তুলে তাকাল না।
‘আমি এসবের মধ্যে নেই!’ বলল কোনোমতে।
‘আছো, আছো, ম্যান। হাত সরিয়ে তাকাও এদিকে। এক্ষুনি গোটা দুয়েক আঙুল কেটে সুভেনিয়ার হিসেবে দিচ্ছি
তোমাকে একটা, পকেটে রেখে দিতে পারবে সৌভাগ্যের প্রতীক
হিসেবে। অন্যটা রাখব আমি। কী বলো?’
‘তুমি একটা বিকৃত রুচির ম্যানিয়াক! বদ্ধ উন্মাদ!’
‘ইশ্শ্! আমি না তোমার প্রাক্তন
ক্লাসফ্রেন্ড, জান-ই দোস্ত; আমাকে এরকম জঘন্য গালিগালাজ করা কি উচিত হচ্ছে, মিলন?’
‘অনেক টাকা সঙ্গে আছে আমার,’ চেঁচিয়ে উঠল
জারিফ, ‘আমাকে ছেড়ে দাও—সব দিয়ে দেবো তোমাদের।’
‘তোমাকে তো আগেই বলেছি, টাকা চাই না আমরা,’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল শাহেদ। ‘টাকা দিয়ে আমাদের কাছ থেকে আয়ু কিনতে চাও? সেটি হবে না। ধরে নিতে পারো, অলরেডি মারা
গেছো তুমি। চলে গেছো, বাকি রয়েছে শুধু ব্যথার অনুভূতিটুকু। বাহ্,’ হেসে উঠল ও, ‘কেমন বললাম
লাইনটা, মিলন?
চলে গেছো, বাকি রয়েছে শুধু ব্যথার অনুভূতিটুকু! সাহিত্যের মতন লাগছে না শুনতে?’
‘আমাকে ছেড়ে দাও,’ কাঁদো কাঁদো
কণ্ঠে বলে চলেছে জারিফ।
‘প্লিজ, সব টাকা নিয়ে ছেড়ে দাও আমাকে। আমার সব টাকা
তোমাদের দিয়ে দিচ্ছি, নিয়ে নাও।’
‘সে ব্যাপারে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না, ম্যান। কাজ শেষ হয়ে গেলে ওগুলো ফেলে রেখে যাব না আমরা। আচ্ছা ঠিক আছে, যাও, এত করে বলছ যখন, নেব। মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছা তো আর ফেলা যায় না! এবার খুশি? দাও, বের করো যা আছে।’
‘আমার ব্রেস্ট পকেটে রয়েছে মানিব্যাগটা,’ বলল জারিফ। ‘ছোরাটা একটুখানি সরাতে হবে।’
এক ইঞ্চি সরে গেল ছোরা। জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে নাক-বোঁচা একটা পিস্তল বের করল জারিফ আহমেদ। মুহূর্তে বদলে গেল শাহেদের চেহারা, একই সঙ্গে সেখানে ফুটে উঠল আতঙ্ক ও অবিশ্বাস। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পর পর দু বার মৃত্যু বর্ষণ করল ভয়াল অস্ত্রটা। গুঙিয়ে উঠল শাহেদ, সিট থেকে গড়িয়ে
সামনের দিকে পড়ল গাড়ির মেঝেতে,
ছুরিটা ছিটকে
পড়ে গেল হাত থেকে। চমকে চাইল ভয়ার্ত মিলন। দেখল সোজা তার দিকে তাকিয়ে আছে পিস্তলটা, ব্যারেলের মুখ দিয়ে নীলচে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
‘প্ল্যানটা ভেস্তে গেল, তাই না?’ জারিফ আহমেদের ঠোঁটে বাঁকা হাসি, চোখে শীতল চাহনি।
‘আমাকেও খুন করবেন নাকি!’ কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল মিলন। বিকৃত হয়ে গেছে
চেহারাটা।
‘তোমাদের মতো বড়লোকের বখে যাওয়া কুপুত্র নই আমি,’ বলল জারিফ। ‘শোনো,
বাছা। তোমাকে খুন করার ইচ্ছে নেই আমার। তোমার বন্ধু যেচে পড়ে খুন হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই ভয়ানক কাজে নেমেছ তুমি, ওর জোরাজুরিতে। ভালো ছেলে
কুসংসর্গে পড়লে যা হয়।
তবে ওর সঙ্গে
জড়িয়ে তুমি এখন বিশ্রী একটা পরিস্থিতিতে আটকে গেছো।’
মাথা নাড়ল জারিফ
এপাশ-ওপাশ। ‘আমার অবস্থান পরিষ্কার—আত্মরক্ষার জন্য আমার লাইসেন্সড্ পিস্তল দিয়ে গুলি করেছি আমি; কিন্তু তুমি? পুলিশের চোখে তুমি শাহেদের সহযোগী, ওর সঙ্গে মিলে আমাকে এখানে ধরে এনে খুন করতে যাচ্ছিলে। আমি না হয় তোমার কথাবার্তা থেকে বুঝতে পেরেছি, বাজে এক বখাটে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ওর
সঙ্গে এসেছ বটে, আসলে মনে-প্রাণে চাওনি তুমি এসব; কিন্তু পুলিশ? পুলিশ তো সে কথা মানবে না। তাদের চোখে
তোমরা দু জনেই সমান অপরাধী। যা-ই হোক, বিচারে যা হয় হবে।
তবে তোমার জন্য
আমার দুঃখই হচ্ছে। যে ভয়ঙ্কর ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়েছ, এর ফলে তোমার বাপের সুনাম,
সম্মান আর অজস্র টাকা বরবাদ হয়ে যাবে। ভাবছি, এ থেকে তোমাকে রেহাই দেওয়ার কোনো উপায়
আছে কি না।’
‘কী বলতে চাইছেন আপনি!’ কথা শুনে চমকে গেছে মিলন।
‘আমার অবশ্য পুলিশকে সব জানাতে থানায় যেতেই হবে; কিন্তু... ভাবছি, তোমার কথা উল্লেখ না করলে চলে কি না। দু জনের কথা না বলে যদি শুধু একজনের কথা বলি? তুমিও ওর সঙ্গে ছিলে বটে;
কিন্তু
আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ছিলে না;
হুম্ম্... মনে
হচ্ছে তোমাকে এই বিপদে
না জড়ালেও চলে।’
‘সত্যি? আমাকে পুলিশে দেবেন না আপনি?’ সামনে ঝুঁকে এল
উত্তেজিত মিলন। চোখ দুটোয় আশা-নিরাশার দোলা। ‘তা হলে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকব আমি, স্যর, আপনার কাছে। আমার বাবাও।’
‘কতটা কৃতজ্ঞ?’ মৃদু হাসি ফুটল
জারিফের ঠোঁটে। ‘বিনিময়ে নগদ লাখ পঞ্চাশেক দিতে রাজি হবেন তো উনি?’
যেন বাজ পড়েছে মাথায়, স্তম্ভিত
দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মিলন।
‘শোনো, বাছা,’ বোঝাবার ভঙ্গিতে বলল জারিফ, ‘বাস্তবতাকে মেনে
নিতে হয়। নিষ্কণ্টক একটা ভবিষ্যত্ উপহার দিচ্ছি
আমি তোমাকে, তার বদলে পঞ্চাশ লাখ টাকা তো তোমাদের
জন্য কিছুই না।’
‘রাজি হবে না বাবা,’ নিচু, হতাশ কণ্ঠে বলল মিলন।
গাড়ি স্টার্ট দিল জারিফ আহমেদ, পিছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল বড় রাস্তায়। ‘তা হলে, কী আর করা, গাজিপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে জানাতে হয়
সব।’
গাজিপুরের চৌরাস্তায় পৌঁছে বামে মোড় নিতেই ভয়ে কেঁপে উঠল মিলন। ‘দাঁড়ান, প্লিজ!’
বলল ও। ‘আগে বরং বাবার কাছে যাই,
উনি কী বলেন
শুনে তারপর না হয় যা করার করবেন। বাসায় মেলা টাকা
আছে, দিয়ে দিতেও পারে।’
‘বেশ, চলো তা হলে।’
নাক ঘুরিয়ে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়ে গেল প্রিমিও। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল উত্তরায়। পথ দেখিয়ে নিয়ে এল মিলন সিরামিক ইট দিয়ে তৈরি উত্তরা আবাসিক এলাকা থেকে একটু
তফাতে এক অত্যাধুনিক ডুপ্লেক্স বাড়িতে। উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা প্রায় তিন বিঘার প্লটে ছোট-বড় প্রচুর গাছের সমারোহ। সুদৃশ্য গেটের গায়ে নেইমপ্লেটে লেখা—মাহমুদ ভিলা। খোয়া বিছানো
ড্রাইভওয়ের দু পাশে হরেক জাতের বিদেশি ফুলের বেড। চাকার নিচে মুড়-মুড় আওয়াজ তুলে পোর্টিকোয় গিয়ে দাঁড়াল প্রিমিও। জারিফ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবা কি একা?’
‘হ্যাঁ। মা আমাদের সঙ্গে থাকে না,
আর কাজের লোক সব
ছুটা। দারোয়ানও আজ ছুটিতে।’
বারান্দায় উঠে বাড়িতে ঢোকার মুখেই ড্রইংরুম। ‘আপনি বরং এখানেই
বসুন স্যর,’ বলল মিলন। ‘বাবা এখন স্টাডিতে।
আমি ভেতরে গিয়ে
সবকিছু খুলে বলি আগে।
উনি যদি কথা
বলতে চান, তা হলে আমি আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব।’
মাথা ঝাঁকিয়ে একটা সোফায় বসে পড়ল জারিফ আহমেদ। স্টাডিতে গিয়ে ঢুকল মিলন, মিন মিন করে কী বলল বোঝা গেল না। তারপরই ভেসে এল
ওর বাবার বাজখাঁই গলা।
তর্জন-গর্জন চলল
বেশ কিছুক্ষণ, তারই ফাঁকে ফাঁকে অবুঝ পিতাকে বাগে আনবার
জন্য পুত্রের আপ্রাণ চেষ্টা। কথাবার্তা থেমে
গেল এক সময়। পর্দা সরিয়ে হাতছানিতে ডাকল মিলন
জারিফকে।
টেবিলের উপর খোলা একটা ফাইল রাখা। সাদা একটা ঢিলেঢালা টিশার্ট আর লুঙ্গি পরে বসে আছেন ব্যারিস্টার মাহমুদ বড়সড়
একটা লেদার মোড়া চেয়ারে।
ভুরু জোড়া
বিপজ্জনকভাবে কোঁচকানো।
কড়া চোখে চাইলেন তিনি জারিফের দিকে, তারপর ধমকের সুরে বললেন,
‘আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে, আপনি যা চাইছেন সেটাকে ব্ল্যাকমেইল বলে? বসুন। ব্ল্যাকমেইল একটা...’
‘আমি তা মনে করি না,’ বাধা দিয়ে নরম
গলায় জবাব দিল জারিফ।
মক্কেলদের জন্য
রাখা দামি চেয়ারে বসল।
‘আমি এটাকে বলব ক্ষতিপূরণ। আমাকে কী পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে তা আমিই জানি, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। কপালজোরে মৃত্যুর
মুখ থেকে ফিরে এসেছি আমি আজ,
আপনার ছেলেও
মারা যেতে পারত। আমি ওকে একটা সুযোগ দিতে চাইছি। আপনার সন্তানের ভবিষ্যত্ নিশ্চয়ই টাকা-আনা-পাই দিয়ে হিসাব
করবেন না। নাকি করবেন?’
‘ভবিষ্যত্টা যদি ওর অতীতের মতো হয়, তা হলে আমি মনে করি, জেলের ভাত খাওয়াই ওর উচিত দাওয়াই। একের পর এক অপকর্ম করে গোটা পরিবারের মান-মর্যাদা স্রেফ
ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। অপদার্থ, নির্বোধ! একের পর এক নোংরা, জঘন্য গোলমালে জড়াচ্ছে স্কুলের বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশে!’ যত বলছেন ততই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন ব্যারিস্টার সাহেব। পরবর্তী পাঁচটা মিনিট তীক্ষ বাক্যবাণে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললেন পুত্রকে।
টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে শুনছে মিলন, পানি গড়াচ্ছে দু গাল বেয়ে;
কিন্তু এতটুকু দয়ামায়া দেখালেন না আশরাফ মাহমুদ। বলেই চললেন, ‘আর আজকের এটা হচ্ছে তেনার সর্বশেষ মহান
কীর্তি... আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে গেছেন খুন-খারাবির
সঙ্গে! ফেঁসে গিয়ে এখন এসেছেন আহ্লাদ করতে, বাবা আমাকে বাঁচাও! বাপের প্রতি সামান্যতম সম্মান বা শ্রদ্ধাবোধ
থাকলে এসবের মধ্যে যায় কেউ? আমার একটা খ্যাতি আছে, সুনাম আছে... সেসবের দিকে একটিবার
তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলি না!’
কথা বলে উঠল জারিফ, নইলে এই খিস্তি
চলবে সারারাত।
‘হ্যাঁ, আপনার মান-সম্মানের কথা ভেবেই আমার ধারণা হলো আমার প্রস্তাবটা আপনার কাছে
গ্রহণযোগ্য হতে পারে।’
‘কিন্তু প-ঞ্চা-শ লা-খ! ক্যাশ পঞ্চাশ লাখ টাকা বল-বলতেই আমি এখন পাই কোথায়!’
‘একটু খুঁজলে বাড়িতেই পেয়ে যাবেন,’ বলল জারিফ। ‘কোটি কোটি টাকা নাড়াচাড়া করছেন, নিশ্চয়ই কিছু
ট্যাক্স-ফ্রি বা অপ্রদর্শিত আয়ের একটা অংশ বাড়িতেই আছে কোথাও।’
‘আপনি কি আমার চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করছেন?’ গর্জে উঠলেন ব্যারিস্টার আশরাফ মাহমুদ। ‘বলতে চাইছেন:
আমার অসত্ উপার্জন আছে, কর ফাঁকি দিয়ে সে টাকা বাড়িতে লুকিয়ে
রেখেছি কোথাও?’
‘কারও চরিত্রে কালি মাখাতে বা কারও ট্যাক্স-ফাঁকি ধরতে আসিনি আমি এখানে, ব্যারিস্টার সাহেব,’ শান্ত গলায় বলল
জারিফ। ‘তবে জেনে রাখুন, পাঁচ মিনিটের
মধ্যে টাকাটা যদি বের না করেন,
তা হলে সোজা
থানায় গিয়ে সব জানাব আমি।’
‘তাই বুঝি?’ হাসির ভঙ্গি করলেন ব্যারিস্টার
মাহমুদ। ‘আমার ছেলে এখন বাড়িতে। আমি কসম খেয়ে বলব, সারাদিন আজ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায়নি ও। পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করবে, না আপনার কথা?’
‘আমার কথা। কারণ, আমি সত্যি কথা
বলব এবং প্রমাণও করতে পারব। তাছাড়া যদি বলি, আপনার ছেলে থানায় যাবার আগে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, আপনিই আমাকে টাকা সেধেছেন,
ওর জড়িত থাকার
কথাটা যাতে চেপে যাই—তা হলেও অবিশ্বাস করবে না পুলিশ আমার কথা।’
‘বাবা,’ বলে উঠল মিলন, ‘ওঁকে না চটিয়ে টাকাগুলো দিয়ে বিদায় করে দেওয়াই ভালো না?’
‘আপনার ছেলে ঠিকই বলেছে, মিস্টার মাহমুদ। নিয়ে আসুন টাকাগুলো।’
‘তোমাকে পুলিশের হাতেই তুলে দেওয়া উচিত ছিল,’ কটমট করে চাইলেন ব্যারিস্টার পুত্রের দিকে। ‘পারছি না শুধু
অসম্মান আর বদনামের ভয়ে! ঠিক আছে,
আনছি টাকা।’
বাড়ির ভেতর চলে গেলেন আশরাফ মাহমুদ। ছেলেও গেল তাঁর সঙ্গে। নড়েচড়ে বসল
জারিফ আহমেদ। টেবিলের উপর বেনসনের প্যাকেট দেখতে পেয়ে
একটা বের করে নিয়ে ধরাল, তারপর চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে একের পর এক ধোঁয়ার রিং ছুড়তে থাকল টেবিলের ওপাশে ব্যারিস্টারের কাল্পনিক মুখ লক্ষ করে। তিন মিনিটের মধ্যে একটা কাগজের ব্যাগ হাতে ফিরে এল মিলন। মনে মনে হাসল জারিফ, নিশ্চয়ই থরে থরে সাজানো ছিল টাকাগুলো।
‘এই যে টাকা,’ বলল মিলন। ‘এগুলো নিয়ে আপনাকে কেটে পড়তে বলেছে বাবা।’
টাকাগুলো গুনে দেখে সন্তুষ্ট হলো জারিফ। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে সিগারেটের আস্ত প্যাকেটটাই তুলে পকেটে পুরল। গাড়ি নিয়ে গেট থেকে রাস্তায় বেরিয়েই বলল, ‘ঠিক আছে, শাহেদ, এবার উঠে বসতে পারো।’
হাচড়ে পাছড়ে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল শাহেদ।
‘উফ্, এতক্ষণ পড়ে থেকে
ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে আমার! আর,
কী বিশ্রী ধুলো
কার্পেটে! পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেছে এসে নাকে-মুখে। আর একটু হলেই হাঁচি মেরে বসতাম। গাড়িটা একটু
পরিষ্কার...’
‘চোরাই গাড়ি পরিষ্কার করতে বয়েই গেছে আমার,’ বলল জারিফ। ‘সব দোষ এটার মালিকের।’ কাগজের ব্যাগের গায়ে দুটো চাপড় দিয়ে বলল, ‘এই টাকায় দু জনের নতুন দুটো প্রিমিও হয়ে
যাবে।’
‘হুপ্-পি! সত্যিই টাকা দিল তা হলে! দেখি
চেহারাটা?’
কোলের উপর থেকে ব্যাগটা তুলে এগিয়ে দিল জারিফ। বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে পড়ল শাহেদের। ‘তার মানে একটুও
সন্দেহ করেনি ওরা—টোপ, বড়শি, ফাতনা সব গিলে ফেলেছে!’
‘হ্যাঁ, ভালো একটা ভোঁদাই মাল খুঁজে বের করেছিলে। কোথায় পেয়েছিলে ওটাকে?’
‘স্কুলে। থাকে না, বড়লোকের পোলা—ডানপিটে,
মস্তান টাইপের
ছেলেদের সাথে খাতির রাখতে পছন্দ করে, মনে করে
প্রয়োজনে হয়তো কাজে দেবে, সেই রকম।’
বড় রাস্তায় উঠেই আবার গাজিপুরের রাস্তা
ধরল জারিফ। ওখানে একটা গ্যারেজে ডেলিভারি দেবে এই
গাড়িটা। আগেই বিক্রি করে দিয়েছে সে এই গাড়ি, এখন পৌঁছে দিলে দুই ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত পার্টস্ খুলে আলাদা করে ফেলা হবে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ নিজের ভাবনায় মগ্ন থাকার পর আবার মুখ খুলল
জারিফ, ‘ওর বাপের যে রকম হাই-ফাই অবস্থা দেখলাম, দ্বিগুণ চাইলেও মনে হয় দিয়ে দিত।’
‘আবার গিয়ে হাজির হতে পারি আমরা,’ বলল শাহেদ।
হেসে উঠল জারিফ। ‘মন্দ বলোনি। আবার, কোনো এক সময়—ইয়েস!’
‘অনেকটা ব্যাংকে টাকা রাখার মতো,’ বলল শাহেদ। ‘ভালো কথা, আমার পিস্তলটা দেন, ফেরত দিতে হবে মনিরুলকে।’
পকেট থেকে অস্ত্রটা বের করে দিল জারিফ। বলল, ‘মাসখানেক পর এক রাতে ব্যারিস্টারের বাড়িতে গিয়ে ভাল করে
খুঁজে দেখতে হবে কোথায় কী রাখে। তিন মিনিটের
মধ্যে এতগুলো টাকা যে লোক বের করে দিতে পারে, তার কাছে আরো
মেলা আছে।’
‘ওহ্-হো,’ গাজিপুরের কাছাকাছি এসেই বলে উঠল শাহেদ, ‘আমার ছোরাটা
পাচ্ছি না। কিছুদূর এগিয়ে গেলেই তো আমাদের সেই স্পট, তাই না?’
‘গাড়িতে ভালো করে খুঁজে দেখেছ?’
‘নেই। খুব সম্ভব অভিনয় করতে গিয়ে হাত থেকে ছুটে জানালা দিয়ে বাইরে পড়েছিল।’
ডানে না ঘুরে সোজা চলল গাড়ি। জায়গামতো পৌঁছে ডান পাশের কাঁচা রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে একটু এগিয়ে কয়েক গজ বামে
গিয়ে থামল প্রিমিও।
নেমে গেল শাহেদ।
‘কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না! লাইট অফ্ করে টর্চটা দিন, আমি ওটা খুঁজে
বের করছি।’
গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ নিয়ে
নিজেও নেমে এল জারিফ, শাহেদের বাড়ানো হাতে দিল। টর্চটা বাম হাতে নিয়ে পিস্তল দিয়ে খোঁচা দিল শাহেদ ওর
পাঁজরে। ‘কয়েক কদম পিছিয়ে যান, জারিফ সাহেব। অন্তত দশ ফুট দূর থেকে সারতে হবে কাজটা।’
‘কী বলছ? কী করতে হবে দশ ফুট দূর থেকে?’
‘খুন!’
টর্চের আলোয় ঝক
ঝক করছে ওর দাঁত। হাসছে শাহেদ। ‘নইলে রক্তের
ছিটা লাগবে না জামায়? খুন করব তো এখন আমি আপনাকে!’
‘ওই খেলনা পিস্তল দিয়ে?’ হাসির ভঙ্গি করল
জারিফ। ‘ফাজলামো রেখে ছুরিটা বের করো খুঁজে।’
‘ছুরিটা কোথায় আছে আমি জানি,’ বলল সে। ‘মিলনের কাছে। ওর বাপের গলায় চালাচ্ছে ও এখন ওটা।’
‘বলছ কী তুমি!’ কেঁপে উঠল জারিফের গলা। কেন যেন মনে হলো
কথাটা সত্যি হতেও পারে।
‘ওর বাবাকে খুন করছে এখন মিলন। আপনাকে শেষ করে
বডিটা নিয়ে ফিরে যাব আমি উত্তরায়। ওর বাপের
স্টাডিতে নিয়ে ফেলব লাশ।
ঘটনাটা দাঁড়াবে
এই রকম—আপনি ব্যারিস্টার সাহেবকে খুন করে বাড়িতে
ডাকাতি করছিলেন। টের পেয়ে আপনাকে বাধা দেবার চেষ্টা করে
মিলন। আপনি ছুরি নিয়ে ওর ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়েন, ফলে ও গুলি করতে বাধ্য হয়। পুলিশের খাতায়
আপনার যা অতীত রেকর্ড আছে, তাতে কেউ অবিশ্বাস করবে না কথাটা।’
‘তোমার ওই পিস্তল দিয়ে খুন করবে আমাকে? ফাঁকা গুলি মেরে?’
‘এটা মিলনের বাবার পিস্তল,’ গম্ভীর কণ্ঠে
বলল শাহেদ। ‘গতকালই ওঁর চেস্ট অভ ড্রয়ার্স থেকে সরিয়েছে। তারপর দু জন মিলে অনেক মাথা খাটিয়ে গোটা প্ল্যানটা সাজিয়েছি
আমরা স্টেপ বাই স্টেপ।
মাকে ভালোবাসে ও, বাপকে দু চোখে দেখতে পারে না,
অনেকদিন ধরে
তাঁর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ খুঁজছে। সমস্যা ছিল একটাই—ব্যাপারটা দেখাতে হবে দুর্ঘটনার মতো, যাতে সম্পত্তিটা হাতছাড়া হয়ে না যায়।’
হাঁ করে এতক্ষণ কথা শুনছিল জারিফ, হাঁসফাঁস করে উঠে বলল, ‘তার মানে আমাকে ব্যবহার করেছ
তোমরা? নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যই জড়িয়েছ আমাকে এসবের সাথে! মনে করেছ আমাকে বোকা বানিয়ে পার পেয়ে যাবে তোমরা?’ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল সন্ত্রাসীর চেহারা।
দাঁতে দাঁত চেপে
বলল, ‘ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলব না?’
শাহেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে পর পর দুটো গুলি খেল জারিফ বুকে। ধাক্কা খেয়ে বিস্ময়ে বস্ফািরিত হয়ে গেল ওর চোখ। ও জানত,
বুলেট থেকে
বারুদ বের করে নেয়া হয়েছে, আওয়াজ হয়েছিল হ্যামারের আঘাতে প্রাইমার
জ্বলে ওঠায়।
‘ফাঁকা বুলেটে...!’ শুধু এই দুটি শব্দই বের হলো ওর মুখ দিয়ে। খাবি খাচ্ছে।
‘না,’ হেসে উঠল শাহেদ।
‘এই দুটো আসল। ফাঁকা ছিল শুধু প্রথম দুটো।’
মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই ওকে ধরে ফেলল শাহেদ, শূন্যে তুলে বয়ে নিয়ে গেল গাড়ির পেছনে। ডালা খুলে আদর করে শুইয়ে বড় একটা সিনথেটিক ছালা দিয়ে ঢেকে দিল লাশ। ট্রাঙ্কের ডালা নামিয়ে উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ঢুকল ও
মাহমুদ ভিলার গেট দিয়ে।
‘সব ঠিকঠাক মতো হয়েছে তো, শাহেদ?’ জিজ্ঞেস করল মিলন। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে এল বন্ধুকে সাহায্য করতে।
‘এক্কেবারে পানির মতন। তুমি পায়ের দিকটা ধরো।’
দু জন মিলে টেনে-হেঁচড়ে বুট থেকে বের করল লাশটা, ছালার উপর ওটা তুলে দু জন ধরল দুই দিক, নিয়ে গেল
ড্রইংরুম পেরিয়ে স্টাডিরুমে। ব্যারিস্টার সাহেব চামড়ামোড়া, পিঠ-উঁচু চেয়ারে
হেলান দিয়ে বসে আছেন বীভত্স ভঙ্গিতে। দু ফাঁক হয়ে আছে
গলাটা। স্ট্যাবও করা হয়েছে হূিপণ্ড বরাবর। ছোরার হাতলটা শুধু দেখা যাচ্ছে—ফলা গেঁথে আছে বুকে। লাল হয়ে গেছে সাদা টি-শার্ট। জারিফের দেহটা
উপুড় করে ফেলল ওরা মেঝেতে। টাইলসে বাড়ি
খেয়ে দুটো দাঁত ছুটে চলে গেল ডেস্কের নিচে।
‘আমি এই ব্যাগটা লুকানোর ব্যবস্থা করছি,’ বলল মিলন। ‘তুমি টাকাগুলো নিয়ে এসো গাড়ি থেকে। পিস্তলটার কথা ভুলো না আবার—ওটা লাগবে
আমাদের।’
যার যার কাজ সেরে আবার ফিরে এল ওরা স্টাডিরুমে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল মিলন স্টেজটা ঠিকঠাক মতো সাজানো
হয়েছে কি না। হ্যাঁ। যেখানে যা থাকার কথা, সব ঠিক সেখানেই আছে। সেফের ডালাটা খোলা, রাবারব্যান্ড
মোড়ানো টাকার কয়েকটা বান্ডিল পড়ে আছে মেঝেতে।
‘কিন্তু এই টাকাগুলো?’ হাতের ব্যাগ
দেখিয়ে বলল শাহেদ, ‘ওরা সব টাকা গুনে দেখবে। এর থেকে পঞ্চাশ লাখ কোথায় গেল প্রশ্ন উঠবে না?’
‘নাহ্,’ মাথা নাড়ল মিলন।
‘ওগুলো এনেছিল বাবা বেডরুমের সেফ থেকে। কেউ জানে না কোথায় বুড়োর কত টাকা ছিল। কাজেই কেউ টের পাবে না কত টাকা খোয়া গেছে। পিস্তলটা এবার
দাও, হাতের ছাপ মুছে-টুছে...’
‘আরি, ভুলেই গেছিলাম!’ পিস্তল ফিরিয়ে
দিল শাহেদ মিলনকে, ‘এবার ভাগাভাগির প্রসঙ্গ। আমার ভাগটা এখনই দেবে, না পরে?’
‘এখনই,’ জবাব দিল মিলন।
তারপর পিস্তলের
বাকি বুলেট ক টা ঢুকিয়ে দিল শাহেদের পেটে।
হুমড়ি খেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল শাহেদ নিল-ডাউনের ভঙ্গিতে। দুই হাতে পেট চেপে ধরে চাইল বন্ধুর দিকে, দুই চোখে অবিশ্বাস, ‘তুমি... তুমি গুলি করলে আমাকে!’
‘তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না শাহেদ,’ বলল মিলন শান্ত
ভঙ্গিতে। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে দেখছে খাবি খেতে থাকা বন্ধুকে। যেন কারণটা বুঝিয়ে না বললে অন্যায় হয়ে যাবে, তাই ভেঙেই বলল, ‘তা হলে গোটা প্ল্যানটাই ভেস্তে যেত। তুমি মস্তান মানুষ, এতগুলো টাকা পকেটে পড়লে দুই হাতে খরচ
শুরু করে সবার চোখে পড়ে যেতে। তারপর একদিন
ভরপেট তাড়ি গিলে গড় গড় করে ফাঁস করে দিতে সব। কাজেই...’
সেজদার ভঙ্গিতে কপাল ঠেকাল শাহেদ মেঝেতে।
গোটা ব্যাপারটা হঠাত্ কেমন যেন নাটকের মনে হলো মিলনের কাছে। প্রথমে খুক খুক করে হাসল, তারপর হা-হা করে।
হাসতে হাসতে
পানি চলে এল চোখে।
বন্ধুর প্রাণটা বেরিয়ে যেতেই রিসিভার তুলে ডায়াল করল মিলন থানার
নম্বরে।
<><><>
সূত্র: ইত্তেফাক ঈদসংখ্যা ২০১১
No comments:
Post a Comment