Friday, May 3, 2013

কঠিন অসুখ - শেখ আবদুল হাকিম

ডাক্তার আমাকে কিছু বলেননি, বলেছেন ভাইকে। ভাই তাতে রঙ-টঙ চড়িয়ে আমাকে জানিয়েছে এটা আমার খুব খারাপ অসুখ। শতকরা নব্বই ভাগ আশঙ্কা আমি পাগল হয়ে যাব। আচ্ছা, শুনলে ভয় লাগে, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়, এ রকম দুঃস্বপ্ন দেখাটা কি সত্যি খুব কঠিন অসুখ? কার কাছে যাব আমি? এ দুনিয়ায় কাকে বিশ্বাস করা যায়! কথাটা বলার সময় দাঁত বের করে হাসছিল সে। এই ভাই পারলে আমাকে খুন করে পৈতৃক সম্পত্তি মেরে দেয়, কাজেই ঠিক করেছি একদিন একাই ডাক্তারের গলা টিপে দিয়ে আসব।

সেদিন বাথরুমে বসে আছি। দেখতে পেলাম এক লোক সুমন আশিক আমার জানালার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে। আমার বললাম কারণ ওখানে আমি পেসাব করতে ঢুকেছি, ওটা এখন আমার বাথরুম, সেজন্যে। এতসব নাটক পাঁচতলায়।

সুমন দাঁড়িয়ে আছে জানালার বাইরে, বাথরুমের ভেতরে নয়; গায়ে সুট, কেউ জানতে চাইলে বলতে পারি সেটা থ্রিপিস নয়; কী কারণে জানি না সে তার টাই খুলে ফেলেছে এবং কেউ জিজ্ঞেস না করলেও বলব বলে ভেবেছি যে তার সুট আর মোজার রঙ ম্যাচ করেনি। এটা আমি খেয়াল করলাম শুধু বসে পেসাব করি বলে। জানি অনেক লোক তা করে না, কিন্তু আমি করি। ছোটবেলায় আমার দাদি আমাকে শিখিয়েছেন বাথরুম সারার সময় তোমার শব্দ অন্য কাউকে শুনতে দেওয়াটা অভব্যতা, শিষ্টাচার-বহির্ভূত।

আমি টয়লেটে বসে আছি, আর ওই লোক, সুমন, সম্ভবত আমার উপস্থিতি টের পেয়েই, ঘুরে তাকাল। বসে পেসাব করার জন্যে টয়লেট সিটটা নামাতে হয়েছে আমাকে, বুঝতেই পারছেন ওখানে যাতে বসতে পারি আমি, আর তাতে চিনামাটির তৈরি টয়লেটের ভিতে ওটা বাড়ি খাওয়ায় ঝনঝন শব্দ হয়েছে। ঘুরে তাকাল সুমন, তাকিয়েই থাকল। ভাগ্যিস তখনও আমি ট্রাউজার খুলিনি। টয়লেটে বসে আমি আমার জুতোর ফিতে বাঁধছিলাম।
এটা বলতে ভুলে গেছি আমি।
মালিনি, আমার অফিস সেক্রেটারি, এলিভেটর থেকে বেরোবার সময় আমাকে দিয়ে আমার জুতোর ফিতে খুলিয়েছে। না, মানে, ওটা দুর্ঘটনাই ছিল, সে নিজেও জানে না তার কারণে আমি আমার জুতোর ফিতে খুলে ফেলেছি। দেখতে যাই হোক, মেয়ে মানুষ যেহেতু, সিগারেট খেতে দেখলে লোকে ছি-ছি করবে, তার ওপর আর কেউ না জানলেও আমি খুব ভালো করে জানি যে, ওই সিগারেটের তামাকে গাঁজা মেশায় মালিনি। এটা তার নেশা, বলে দিয়েছে এর জন্য অফিস, চাকরি, স্বামীসহ জগৎ সংসারে এমন কিছু নেই যা সে ত্যাগ করতে পারে না। গাঁজার একটা গন্ধ আছে, সেটা লুকানোর জন্য এলিভেটরে চড়ে সোজা সাততলার ছাদে উঠে যায় মালিনি। যেখানে একেবারে একা আয়েশ করে গাঁজায় দম দিতে পারে। তো গাঁজা ভরা সিগারেট শেষ করে নিচে নামছিল সে। এলিভেটরের দরজা খুলে যেতে তাকে দেখতে পেলাম, কথা বলব না ভেবে পাশ কাটাচ্ছি। তারপর অপরাধ বোধ জাগল, ভাবলাম এ রকম কর্কশ অবহেলা তার প্রাপ্য নয়। কাজেই কথা বলার জন্য ঘুরলাম, আর ওই ঘুরতে গিয়েই আমি আমার বাম ফিতে মাড়িয়ে ফেললাম।
মালিনি ভান করল আমাকে সে দেখতে পায়নি। তার এই অবহেলায় আমার কিছু মনে করার ছিল না। কারণ নেশা তো আর আমি করিনি।
কাছেই বাথরুম, আমার আগে আরেকজন ঢুকে পড়ল। কাজেই সিঁড়ি বেয়ে আমাকে চার থেকে পাঁচতলায় উঠতে হচ্ছে। সাততলা হলে কি হবে, এটা অনেক বছরের পুরনো বিল্ডিং, বহুদিন হয়ে গেল মেরামতও করা হয় না। এই ভবনের ডিজাইন তৈরির সময় সংশিল্গষ্ট লোকজন তাদের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করেনি।
পাঁচতলায় ওঠা মাত্র ওসমান আদিলকে দেখতে পেয়ে আমার পিলে চমকে উঠল। খুব নার্ভাস হয়ে পড়লাম, আর তখন বাকি ফিতেটাও খুলে গেল। কারণ ওই লোককে দেখে দ্বিতীয়টাও মাড়িয়ে ফেলেছি। তবে দুটোর কোনোটাই তখন বাঁধতে পারলাম না। কারণ মনে হলো ওসমান আদিল দেখতে পেয়েছেন আমাকে এবং যদিও আমি শুধু বাথরুমে যাচ্ছি, আর বাথরুমে যাওয়া অপরাধ নয়, তারপরও আমার ভেতর অপরাধ বোধ সংক্রমিত করার জন্য কোনো না কোনো উপায় ঠিকই খুঁজে বের করবেন তিনি। আমাদের শিপিং অফিসে তিনিই এখন এক নম্বর ব্যক্তি। গত জুলাইয়ে মালিক জনাব কুদরতে রাহিম গুলশান লেকে মরে ভেসে ওঠার পর থেকে। ওসমান
আদিল টেকনাফ থেকে এসেছেন, তার আগে ছিলেন মিয়ানমারে, তিনবার বিয়ে করেছেন। কিন্তু কোনো সন্তান নেই। আপনমনে বিড়বিড় করে কিছু বলছিলেন। চোখে কেমন যেন একটা চকচকে দৃষ্টি। যাই হোক, পাঁচতলার বাথরুমে খালি পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে পড়লাম, টয়লেটে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছি।
জানি না কী ভাবছিলাম। তবে ফিতে বাঁধা শেষ হওয়ার পরও যখন দেখলাম ওই লোক সুমন আশিক আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তখন আমি বললাম_ তার মোজা দুটো সুটের সঙ্গে ম্যাচ করেনি।
'কি?' সুমন মুখ নাড়ল।
আমার কথা শুনতে পায়নি। জানালা বন্ধ, পরস্পরকে আমরা কাচের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। জানালা খোলার জন্য টয়লেট ছেড়ে উঠলাম। পুরনো আমলের জিনিস, জানালার ফ্রেম ওপরে ওঠে না, বাইরের দিকে খোলে। কাজেই তাকে আমার বলতে হলো, গলাও চড়াতে হলো যাতে শুনতে পায়, তাড়াতাড়ি বাঁ দিকে একটু সরে যান, আমি যাতে জানালাটা খুলতে পারি।
'কি!?'
এবার প্রথমে গলা না চড়িয়ে, তার মতোই মুখ নেড়ে বলার চেষ্টা করলাম। এটা অনেককে করতে দেখেছি। বিশেষ করে কেউ যখন গাড়িতে থাকে, কথা বলছে আরেক গাড়িতে বসা কারও সঙ্গে, হয়তো কোনো ট্র্যাফিক সিগন্যালে, হয়তো পরস্পরকে তারা চেনে।
'বাঁ দিকে সরে যান। তা না হলে জানালা খুলতে পারছি না। এটা বাইরের দিকে খুলবে, ওপর দিকে নয়।' হাত ব্যবহার করে বোঝাবার চেষ্টা করছি কী করতে হবে তাকে। দু'তিন সেকেন্ড পর বোঝাতে পারল সে।
ঠেলা দিয়ে জানালা খুলছি, কিন্তু এখানে আরেকটা সমস্যা হলো। জানালার কপাট আটকে গেছে। শুনুন, জানালাটা বেশ লম্বা, মেঝে থেকে প্রায় সিলিং পর্যন্ত পুরোটা সাদামাটা স্বচ্ছ কাচ, ঝাপসা নয়_ বিশেষ করে মেয়েদের জন্য যেটা দরকার ছিল তারপর আমি যখন ওই জানালা ঠেলা দিয়ে খুলছি, ওটা দু'ভাগ হয়ে গেল। একটা কপাট গেল ডান দিকে, আরেকটা বাম দিকে। আর কার্নিশের মেঝের সঙ্গে আটকাল বাম অর্থাৎ যেটা সুমনের দিকে। যখন বুঝলাম পা ফেলে ওটাকে ঘুরে আসতে পারবে না সে কপাটটা আবার বন্ধ করতে চাইলাম। কিন্তু এমন আটকাই আটকেছে যে এখন আর সেটা বন্ধও হচ্ছে না।
বাঁ দিকের কপাট যদি পুরোটা পথ পার হয়ে বিল্ডিংয়ের দেয়ালে গিয়ে ঠেকে, সুমন তাহলে ওটাকে পাশ কাটিয়ে খোলা জানালার সামনে চলে আসতে পারে, তারপর ঢুকে পড়তে পারে আমার বাথরুমে। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তার এখন নড়াচড়া করার উপায় নেই। এখানে আরেকটা কথা বলি, এই বাথরুম পাঁচতলার সর্বশেষ কামরা, বিল্ডিংয়ের পুবদিকে।
সোজা কথায়, ফাঁদে পড়েছে সুমন। তার যাওয়ার মতো আর কোনো জানালা নেই। পেসাব করার কথা ভুলে যেতে হলো আমাকে।
বাইরের দিকে ঝুঁকলাম, কাচের ভেতর দিয়ে দেখছি তাকে। 'এই যে, ভাই, সুমন! আমি শুধু আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম আপনার মোজার রঙ ... আপনার সুটের সঙ্গে ... ম্যাচ ... করেনি।'
আমাকে মাফ করতে হবে। কারণ আমার মাথায় তখন কি চলছিল সত্যি বলতে পারব না।
তারপর জানেন, কী ঘটল? কল্পনা করতে পারেন, কী করল সে? ভেঁউ ভেঁউ করে কেঁদে দিল সুমন আশিক। আর সেটা স্বাভাবিক কান্নাও নয়, খুব গভীর ক্রন্দন_ ঠোঁটের দুটো কোণ থেকে দুটো লম্বা ধারায় নেমে এলো লালা, সেগুলো ছিঁড়ে গিয়ে তৈরি হলো ফোঁটা, পাঁচতলার নিচে খসে পড়ছে।
নিজেরই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না লোকটাকে সত্যি আমি বলেছি তার মোজা আর সুট ম্যাচ করেনি। জিজ্ঞেস করলে আমি বলতে পারব না কি ছাই ভাবছিলাম তখন।

আট মিনিট আগে সুমন আশিকের চাকরি খেয়েছেন ওসমান আদিল, অপরাধবোধকে এতটুকু প্রশ্রয় না দিয়ে, বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ব্যতিরেকে। তার মানে ওসমান আদিলকে আমি পাশ কাটিয়েছি তিনি যখন সুমনের অফিস থেকে ফিরছিলেন। অর্থাৎ বাথরুম সারার জন্য আমি পাঁচতলায় না উঠলে এত বড় একটা ঘটনা আমার জানা হতো না।
সুমন আশিক বলছে [এ বিষয়ে একদম চুলচেরা আর নিখুঁত তার হিসাব] স্মোকিং রুমের জানালা গলে কার্নিশে বেরোতে, তারপর বিল্ডিংয়ের এই দিকটায় আসতে ছ'মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড সময় লেগেছে তার। প্রতি মিনিটে দু'পা করে এগিয়েছে, একদম নির্ভুল মাপ, শুধু কোনটা বাদে। এই পদ্ধতি সম্পর্কে খুবই সতর্ক সুমন, সেটা লক্ষ্য করে ধারণা করলাম নিজের পেশাতেও, একজন হিসাবরক্ষক হিসেবে নিশ্চয় একই রকম দক্ষ সে। বলা উচিত, বুঝতেই পারছেন, দক্ষ ছিল। সুমনের মধ্যে আরেকটা ব্যাপারে খুব ব্যগ্র ব্যাকুলতা দেখলাম_ নিজের বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানে।
হ্যাঁ, বিল্ডিংয়ের এই দিকটা অবশ্যই এক্সিকিউটিভ কার পার্কিংয়ের দিকে মুখ করা। প্রথমে আমি বুঝিনি ব্যাপারটা কেন গুরুত্বপূর্ণ।
সুমন আশিকের স্ত্রী সুমনা গর্ভে যমজ বাচ্চা নিয়ে প্রসবের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। মেয়েটার চাকরি নেই। কোম্পানিতে চাকরি করার সুবাদে চমৎকার হেলথ প্ল্যান ছিল সুমনের। একই পদে দু'মাস কম পাঁচ বছর কাটাল সে। মেয়েদের এই দিকটাতেই পদোন্নতি শুরু হয়। চাকরিটাও ছিল খুঁতখুঁতে মানুষের জন্য আদর্শ, তাকে দেখে যেমনটি মনে হচ্ছে।
সুমন বলছে, তার কোনো ধারণা নেই টাকাটা কী হয়েছে। তার কথা আমি বিশ্বাস করি। তারপর আবার তার সেই কান্না শুরু হলো।
'প্রতিদিন কত কাগজে সই করি। সই করতে করতে হাত ব্যথা হয়ে যায়। সব কি আর পড়ে দেখা সম্ভব। ফওজিয়াকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সাক্ষী দেবেন ... তো এ রকম একটা কাগজে সই করেছি, দেখিনি যে তাতে বলা হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ করলাম ...।'
মালিনি গাঁজা খেতে পারে, তারপরও অন্তত তার দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু ফওজিয়া সম্পর্কে সত্যি আমি তেমন কিছু জানি না। শুধু এটা বাদে যে, দুই ঈদেই ঘাগরা পরতে পছন্দ করে সে মিসরীয় মেয়েদের মতো।
টাকাটা মোটা বলছে, নিশ্চয় অনেক মোটাই হবে।
চোখ নামিয়ে আমাদের নিচে তাকালাম। শুনুন, পাঁচতলা এত বেশি উঁচু জায়গা নয় যে, এখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে নিচের লোকজন তা খেয়াল করবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তাই। এমনকি বিল্ডিংয়ের বাইরের কার্নিশে সুমন আশিক দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ সেটা দেখতে পাচ্ছে না। পার্কিং এরিয়ায় লোকজন খুব কম, তারপরও দু'একজন হাঁটাহাঁটি করছে। কিন্তু কী কারণে জানি না, কেউ তারা মুখ তুলে ওপরের দিকে একবারও তাকাচ্ছে না।
তার কান্না থামল।
তারপরই আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে বসল সে।
'আপনাকে বলতে হবে আপনি আমাকে মাফ করেছেন! চুপ করে থাকবেন না, বলুন!' কি মুশকিল, লোকটা দেখছি অসম্ভব অযৌক্তিক হয়ে উঠছে।
বাধ্য হয়ে কথাটা বলতে হলো আমাকে। 'ঠিক আছে, আপনাকে আমি মাফ করলাম।'
এটা কার কি ক্ষতি করবে? আমি কিছু বলায় যদি বুঝতে পারে কী করতে যাচ্ছে সে, এতে যদি যুক্তি ধরে চিন্তা করতে সহায়তা পায়, অবশ্যই বলব আমি। মানে, বলেছি আমি। হতে পারে কোম্পানির পক্ষ নিয়ে তাকে বলা আমার কথাগুলো মোটেও স্বাভাবিক ছিল না, শুনতে ভালো লাগেনি তার। কি জানি। একই সঙ্গে হঠাৎ উপলব্ধি করলাম এই লোককে ক্ষমা করা আমার জন্য বিরাট একটা দায়িত্ব।
আমাদের অফিসের ঠিক উল্টো দিকে কমিউনিটি কাউন্সিলিং নামে একটা সংগঠনের অফিস আছে। ওদের একটা টিম, নাম ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। আমি যখন প্রথম এই অফিসে চাকরি নিয়ে ঢুকি, ওই টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটা সেমিনার পরিচালনা করার জন্য। বিষয় ছিল_ 'কর্মীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা'।
আমি যাইনি। কারণ আমার মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা ছিল না। ঘাড়ের ওপর খুলি নামে যে ছোট্ট বাক্সটা আছে সেটাকে বেশি খেলাতে আমি বোধহয় ভয় পাই।
'সুমন, আমি জানি এখান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ার কথাটা আপনি মুখ ফুটে উচ্চারণ করেননি। এর কারণ হলো, আদৌ যদি আপনি লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, সেটা বাতিল করে দিয়েছেন_ অন্তত আমি তাই আশা করছি।'
'আ-আ-আমি শুধু, আ-আমি ...' সুমন তোতলাতে শুরু করল আরও কিছু বলে কি-না শোনার জন্য অপেক্ষা করছি আমি।
আর কিছু বলছে না। স্রেফ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকল সুমন।
হতাশ না হয়ে আর কি হবো বলুন। এখন প্রায় আওয়াজ না করে ফোঁপাচ্ছে সে।
'আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট, সুমন! এটা আপনি ভুলে থাকতে পারেন না! আপনাকে তাঁর দরকার; আপনি ওই বাচ্চা দুটোর একমাত্র ভরসা। না হয় আপনি চাকরি হারিয়েছেন। চাকরি একটা খুঁজে নেওয়া এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়!'
নিজের কানেই ঠাট্টার মতো লাগল কথাটা। একবার চাকরি খোয়ালে বাকি সব অফিসের দরজা কেন যেন বন্ধ হয়ে যায়।
ক্ষেপে উঠে জানালার গায়ে ঘুষি মারল সুমন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ভাঙা কাচ, বেশিরভাগ কার্নিশেই পড়ল। যদিও শব্দ পেলাম না, তবে কিছু টুকরো পাঁচতলার নিচে ফুটপাতেও পড়েছে।
এবার আমি ট্রাউজারে পেসাব করে দিলাম। কাচ বিঁধার একটা পুরনো ভয় আছে আমার। বাবা অ্যালকোহলিক ছিলেন কি-না।
আল্লাহই রক্ষাকর্তা, আমার গায়ে একটা কাচও লাগেনি। শুধু ভাবছি আমরা কিচেনে থাকলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারত। নিজেকে বললাম, ভাগ্যের প্রতি কৃতজ্ঞ হও যে, আমরা কিচেনে নেই।
এটা স্বাভাবিক যে, তার হাত থেকে রক্ত ঝরবে। সিঙ্কের দিকে ছুটে গেলাম, টাওয়েল ডিসপেনসার থেকে টান দিয়ে ছিঁড়ে নিলাম পেপার টাওয়েলের একটা রোল। রোলটা থেকে বড় একটা শিট ছিঁড়তে চেষ্টা করছি। বাধা দিল সুমন। ভাঙা জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে পুরো রোলটা কেড়ে নিল। তারপর ছুড়ে ফেলে দিল শূন্যে। হাতে কাচ বিঁধে রয়েছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। খুদে কিছু কণা আঙুলের উল্টো দিকেও গাঁথা দেখলাম।
'সুমন। ভেতরে আসুন। পিল্গজ। লাফ দেবেন না। মানে আমি বলতে চাইছি ... দেখুন, দেখুন! আপনি কাচ ভেঙে ফাঁক তৈরি করেছেন। ওটা গলে ভেতরে চলে আসতে পারবেন। আর আমি অন্তত একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে পারব ... হাসপাতাল এক পা দূরে।'
'একদম চুপ করুন। চুপ করুন। চুপ করুন।'
এদিকে বাথরুমে আর কেউ আসছে না দেখে অবাক হচ্ছি আমি। এই বিল্ডিংয়ে আমরা যারা আছি তাদের বল্গাডার দেখা যাচ্ছে খুব শক্ত। আসলে আমার খুব রাগ হচ্ছে, সত্যি বলছি। আমাকে কী কারণে এ রকম একটা ঝামেলা মেটাতে হবে? আমি সুমন আশিকের একদম ঘনিষ্ঠ কেউ নই; আমরা এমনকি একই ডিপার্টমেন্টে কাজও করি না। খোদা, কি কুক্ষণে আমি তার মোজার দিকে তাকাতে গিয়েছিলাম।
তারপরও, এটার সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেছি।
আচ্ছা, এখানে কী করছি আমি? নিজের ওপর ভরসা রাখতে জানে না এমন এক খামখেয়ালি লোকের প্রাণরক্ষার আবেদন জানাচ্ছি। দালালি করছি তার ভূমিষ্ঠ না হওয়া যমজ দুটো বাচ্চা আর স্ত্রীর জন্য। এই দালালিটা অবশ্য মানবিক। একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করলাম।
কান্না থামিয়ে দাঁড়াল সুমন। ভঙ্গিটা আধো দাঁড়ানো, আধো উবু হয়ে থাকা। তার সুটের অনেক জায়গায় রক্ত দেখতে পাচ্ছি। নেভি বল্গু রঙ, পলিস্টার মেশানো কাপড়। জানালার খালি ফ্রেমে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। বিল্ডিংয়ের দেয়ালে হাত রাখল সে পুরোপুরি সিধে হয়ে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, ভাবলাম আমি। কাঁধের পেশিতে ঢিল পড়তে দেখলাম, দেয়ালে হেলান দিল। আন্দাজ করলাম নির্ঘাত ছ'ফুট লম্বা। বোধহয় সেজন্যই তার পায়ের মোজা ধরা পড়েছিল আমার চোখে। পায়ের পুরোটা দৈর্ঘ্য ঢাকতে পারেনি তার ট্রাউজার। জানালার ফ্রেম আঁকড়ে ধরল সে।
আমার বাম হাত এত জোরে কাচবিহীন জানালার ফ্রেম ধরে আছে যে আঙুলের প্রতিটি গিঁট সাদা দেখাচ্ছে; এটা বাঁ দিকের ফ্রেম, যেটা কার্নিশের মেঝের সঙ্গে আটকে গেছে। সুমন প্রথম যখন দাঁড়াতে শুরু করল, আমার ডান হাত তখন ছুটে গেল ওটাকে ধরার জন্য, ব্যাকআপ হিসেবে। আমার ধারণা, আমি তখন এত বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছি। মনে থাকল না যে ... জানালার ফ্রেম ধরে থাকা অবস্থায় পিছু হটার সময় মনে থাকল না যে, সুমন আশিককে নড়াচড়ার জায়গা দিতে হবে। একদিকে ফ্রেমটাকে আমি টানছি, আরেক দিকে সুমনের ভারী শরীরের ওজন চেপেছে ওটার ওপর। এই দুই শক্তিই বোধহয় দরকার ছিল জানালাকে ফ্রেমসহ খুলে আনার জন্য। আর আমি যখন ওখানে দাঁড়িয়ে পেসাবে ভিজে আছে ঊরুসন্ধি। জানালার ফ্রেম ছেড়ে দিতে অক্ষম। সুমন আশিক দ্রুত খানিকটা বাতাস টানল নাকে। ইটের দেয়াল থেকে ছুটে গেল তার হাত। খুলে আসা জানালার নিচের দিকটা কষে ধাক্কা মারল তার পায়ে। কার্নিশের কিনারা থেকে শূন্যে পড়ে গেল সে, নিঃশ্বাস না ফেলে।
আমি বলতে চাই বাদামি রঙের পেপার রোলের সমান গতিতে তার পতন ঘটল ফিজিক্সের নিয়ম অনুসারে। কিন্তু তা সুমন পড়েনি। সে পড়ল স্লো মোশনে।
আমি তাকে সবটুকু দূরত্ব ধরে একেবারে সেই ফুটপাত পর্যন্ত খসে পড়তে দেখেছি। বেআইনিভাবে পার্ক করা একটা গাঢ় নীল লেক্সাসের পাশে পড়ল। তার সুটের যে রঙ, তার চেয়ে খুব বেশি মাত্রায় ম্লান নয় ওই গাড়ি। এখন কোনো পথিক তাকে দেখতে পেলে ধরে নেবে ওই লেক্সাস থেকেই গড়িয়ে পড়েছে সে। নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হওয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তারপর মারা গেছে। এত উঁচু থেকে পড়ার পরও বেশ সুশৃঙ্খল আর গোছানো লাগছে তাকে। যেন সন্তুষ্ট একজন মানুষ কাত হয়ে দিব্যি আরামে শুয়ে আছে ওখানে।
মনে হয় আমি তাকে খুন করেছি। সেটা নিজের কাছে স্বীকার করতে আমার যে ভালো লাগছে তা কিন্তু নয়।
অবশ্যই সে রকম কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। আর এখন আমি মনে করি, তার মোজার রঙ কী ছিল সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তবে, এখন আপনাদের জানানো যায়_ রঙটা ছিল হালকা সবুজ, কচি কলাপাতার মতো।
কিংবা ফর্সা কোনো তরুণ দাড়ি কামালে তার মুখে যে সবুজ ভাব দেখা যায়, সে রকম। এই রঙের মোজা কখনও দেখিনি আমি। আশা করি, আর কখনও যেন দেখতেও না হয়।
মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। বাথরুমে বসে শুধু ঘুমিয়েই পড়িনি, পুরোদস্তুর একটা দুঃস্বপ্ন দেখাও এইমাত্র শেষ করলাম। ফোনের বোতাম টিপতে কানে ভাইয়ের গলা ভেসে এলো, 'কি রে আশিক, কখন থেকে ফোন করছি, আবার কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলি বুঝি?'  

☀ সমকাল: কালের খেয়া ☀ 
শুক্রবার |৩ মে ২০১৩ |২০ বৈশাখ ১৪২০ |২১ জমাদিউস সানি ১৪৩৪

No comments: