Tuesday, September 10, 2013

তেরো নাম্বার বেঞ্চ — শেখ আবদুল হাকিম





মেয়েটির মধ্যে জরুরি তাগিদ এবং আন্তরিকতা আছে, কিন্তু ছেলেটি দ্বিধায় ভুগছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সবকিছু ঘটতে পারে। হয়তো আর দশজনের বেলায় যা ঘটে তাই ঘটবে, কিংবা ওরা লোক হাসাবে, অথবা নিজেরা হাসাহাসি করবে। তা না হলে করুণ একটা কিছু জন্ম নেবে_ নির্ভর করে মেয়েটির মন-মেজাজ আর অভিজ্ঞতার ওপর। আলোচ্য দৃষ্টান্তে ফলাফল হিসেবে বেরিয়ে এলো একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সেটা ওরা দু'জনেই রক্ষা করল।
ময়ূর সিরাজি তিনটে জিনিস নিয়ে প্যারিসে এসেছে :মহৎ একটা লক্ষ্য, ওকে অনেক বড় শিল্পী হতে হবে; রঙ সম্পর্কে নিজস্ব থিয়োরি; এবং এক মেয়েকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার বাবার কাছ থেকে বিশ লাখ টাকা। প্যারিস এর সবটা নিয়ে দারুণ-নিদারুণ সব রকম খেলাই খেলে। দেশে যে সুন্দর মেয়েটির সঙ্গে ওর এনগেজমেন্ট হয়ে আছে, তার বিশ্বাস সিরাজির নিয়তি বড় একজন শিল্পী হওয়া। কারিগরি ফলানো এই বিশ্বাস বা মতিভ্রম শেয়ার করে ছেলেটিও।
বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্যারিস শিল্পকলার ছাত্রজীবনে ঢুকে পড়ল সিরাজি, তবে ওকে যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, প্রত্যাশার সঙ্গে সেগুলোর মিল থাকছে না। বই আর পত্রিকায় চোখ সেঁটে, কবিতা আর প্রবন্ধ গিলে, এবং ইন্টারনেট ঘুঁটে জানতে পেরেছিল শেইন নদীর বাঁ এবং দক্ষিণ তীরে বিরাট বিরাট ভার্সিটি আছে। ছাত্র আর শিল্পীরা সেখানে শুধু আলো ছড়ায়, বিশেষ করে মেধাবী ছাত্র আর শিল্পীদের মাথার চারপাশে স্বর্গীয় আলোর বলয় দেখতে পাওয়া যায়। মানে যদি তোমার দেখার চোখ থাকে আর কি। ওই জায়গার নাম, সেই মধ্যযুগ থেকে, ল্যাটিন কোয়ার্টার। কিন্তু ওকে হতাশ হতে হলো। কারণ ল্যাটিন কোয়ার্টারে সবই আছে, শুধু ওই আলো বাদে। রোমান্স বেশুমার, কিন্তু খুব বেশি সস্তা, নোংরাও কম নয়, এবং পুরো ব্যাপারটা টাকা ছড়ানো আর তা কুড়িয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা মাত্র।

প্যারিসে আপনি সম্ভাব্য প্রায় সবকিছুই পাবেন, শুধু ভালো কিছু বাদে। ভালো কিছুর অস্তিত্ব নেই তা নয়, অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা খালি পকেটের একজন সাধারণ আর্ট স্টুডেন্টের নাগালে চলে আসাটা বিরল ঘটনা। অথচ সেই বিরল ঘটনাই ঘটল, কারণ ভাগ্য ওই তরুণের বিরুদ্ধে ছিল না, ওটা সে পেল যখন পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়েছে।
ময়ূর সিরাজির মতে, শিল্প জিনিসটা খুব বেশি ম্লান হয়ে গেছে। ওর থিয়োরি, রঙ নিষ্প্রভ হওয়ার পর থেকে দুনিয়াকে অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। যে জিনিস যেমনটি রয়েছে তেমনটি আঁকতে পারতে হবে ওকে, ওর ছবিকে কেউ ক্যাটকেটে বা রুচিহীন বললেও নিজের পথ থেকে একচুল সরবে না। অনেক চেষ্টা-তদবির করার পর নটর ডেম চার্চে ইজেল বসানোর অনুমতি পাওয়া গেছে, ওখানকার প্রায়-অন্ধকার পরিবেশে বসে মাথার ওপরকার প্রকা রোজ উইন্ডো থেকে যে রঙ বিচ্ছুরিত হয় সেটার উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে চেষ্টা করছে ক্যানভাসে। তারপর দেখা গেল ওই বিশাল জানালার স্বচ্ছ দীপ্তির তুলনায় ওর ক্যানভাসের আলো ম্লান_ এটা ভেবে হতাশায় ভুগছে বেচারা।
তো একদিন পরাজয় মানা দীর্ঘশ্বাস ফেলেটুলে একটু নড়েচড়ে বসল সিরাজি, এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে এক পলক দেখতে পেল, রঙ করা কাচের চেয়ে সুন্দর_ মানুষের শিল্পকর্মের চেয়ে ঈশ্বরের শিল্পকর্ম যেমনটি সব সময় সুন্দর। স্বচ্ছ, বুদ্ধিদীপ্ত, মায়াভরা একজোড়া কালো চোখ; এই ছিল, এই নেই। তবে ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে, তারপরই পাতা দুটো নেমে এসে ঢেকে দিয়েছে জাদুভরা ওই সৌন্দর্য। চোখের বদলে, যে মিষ্টি মুখে শোভা পাচ্ছে ওগুলো, সেটা একটু বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। এটা পরিষ্কার যে, কিশোরীর দৃষ্টি ওর কাজের প্রশংসা করছিল, সেটা কলেজ শিক্ষকদের কাছ থেকে যে প্রশংসা পাবে বলে আশা করা হয় তার চেয়ে বেশি কিছু।
প্যারিসে দেশি-বিদেশি যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে তারা ওর মেয়েবন্ধু যোগাড় করতে না পারার ব্যর্থতাকে আত্মবিশ্বাসের অভাব বলে মানতে রাজি নয়। তারা সরাসরি ওর গায়ের শ্যামল রঙকে দায়ী করে, বর্ণবৈষম্য নাকি নিরানব্বই শতাংশ অটুট। পেইন্টিং টুল ছেড়ে নামল ও। মাথা নোয়াল, জিজ্ঞেস করল এক মিনিট বসবে নাকি; ওই...ওই ছবিটা তাহলে আরও ভালো করে দেখতে পারত। উত্তরে মেয়ে কিছু বলল না, তবে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে, তারপর ছুটে পালাল যার সঙ্গে এসেছে তার ছায়ার ভেতর_ বয়স্কা এক মহিলা, এই মুহূর্তে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় মগ্ন। পরিষ্কার বোঝা গেল, যে মহিলার পাহারায় সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তার চেয়ে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে ওর প্রার্থনা। যেখানে প্রয়োজনটা বেশি, প্রায়ই দেখা যায় প্রার্থনা সেখানে সংক্ষিপ্ত। সুইং ডোর খুলে এক পাশে সরে দাঁড়াবার সময় কিশোরীর ওই মায়াভরা কালো চোখ দুটো আরেক বার দেখার সুযোগ পেল সিরাজি। অসচেতন মহিলা আর সচেতন মেয়েটি ওকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল চার্চ থেকে।
এভাবেই শুরু হয়েছিল ওদের মহাকাব্য।
নটর ডেমের রঙিন জানালার ছবি আঁকতেই সিরাজির বেশির ভাগ সময় বেরিয়ে যাচ্ছে এখন। অক্লান্ত পরিশ্রম আর দৃঢ় সংকল্প ছাড়া মহৎ কোনো কাজ কখনও সম্পন্ন হয়নি। এটা লক্ষণীয় যে, এই সত্যটা সে উপলব্ধি করেছে কাজটা করার সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর। সুইং ডোর পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত বদলে গেল, আবার রঙের পেছনে ছুটবে ও। রঙের ওপর প্রচুর পড়াশোনা করবে, এ প্রসঙ্গে যা কিছু জানার আছে তার সবই জানতে হবে ওকে।
তারপর ওই মেয়ের সঙ্গে আবার দেখা হলো। আবার মানে বারবার। প্রতিবার একই সময়ে, প্রহরী হিসেবে সব সময়, সঙ্গে সেই বয়স্কা মহিলা। মহিলার চোখকে ফাঁকি দিয়ে একবার মেয়েটির হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিতে পারল সিরাজি। মেয়েটি সেটা গ্রহণ করায় এবং মুঠোর ভেতর লুকিয়ে ফেলায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল ওর মন। আরেক দিন প্রকা এক স্তম্ভের গাঢ় ছায়ার ভেতর পিছিয়ে এসে ফিসফিস করে দু'একটা কথা বলতে পারল মেয়েটির সঙ্গে। ফোন নম্বর বিনিময় করল ওরা। তারপর থেকে তুলনায় বেশ সহজেই তৈরি হতে থাকল ওদের সম্পর্ক। কিশোরী শ্বেতাঙ্গিনী একদিন ওর নাম জানতে চাইল। ওর নামের প্রথম অংশটা বেশি পছন্দ করল সে, ময়ূর। সে জানাল, শুধু তোমার রঙের খেলা নয়, শুধু তোমার পেইন্টিং নয়; তোমার কালো চোখ অসম্ভব ভালো লেগেছে আমার। ওই চোখ একজন সৎ ছেলের, যার একটা দরদি মন আছে, যে স্বপ্ন দেখতে জানে, যে স্বপ্ন দেখাতে জানে। আর তোমার গায়ের রঙের টেক্সচার আমাকে জাদু করেছে। তোমাকে দেখামাত্র ইচ্ছে করেছে ছুঁঁয়ে দেখব। আর ময়ূর বলল, স্বয়ং ঈশ্বরের হাতে তৈরি শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের একটা মনে হয়েছে তোমাকে আমার। উপলব্ধি করেছি, তুমি শুধু আমার সাবজেক্ট। আর রাশি রাশি মায়া আমাকে পেতে হবে তোমার ওই চোখ দুটো থেকে।
তারপর গুরুতর প্রশ্নটাও একদিন উঠল। কার কী ধর্ম, তা যদি আলাদা হয় তাহলে কী হবে ইত্যাদি। আলোচনার মাঝপথে থামল ওরা; এটা যখনকার ব্যাপার তখন দেখা যাবে বলে দু'জনেই হেসে উড়িয়ে দিল প্রসঙ্গটা।
মেয়েটির জন্ম ফ্রান্সে, এই প্যারিসেই, তবে তারা ঠিক স্থানীয় নয়, ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ। তার নাম সেলিনা। ওদের গোপন সাক্ষাৎকার সাধারণত নটর ডেমের পেছনের ছোট পার্কে অনুষ্ঠিত হয়। ফোয়ারার দিকে মুখ করে বেঞ্চের ওপর বসে ওরা, কিংবা সারি সারি গাছাপালার নিচে কাঁকর ছড়ানো পথ ধরে আসা-যাওয়া করে। বিকেলের দিকে পার্কের নির্জন অংশে চলে আসে, বিশাল চার্চের ছায়ায়। মেয়েটির একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দেয় ঠিক কখন সে পার্কে থাকতে পারবে। তাতে বেঞ্চের নম্বরও লেখা থাকে। কেননা, মাঝেমধ্যে পাহারাদার মহিলাকে এড়ানো সম্ভব হয় না। সেলিনা মহিলাকে ফাঁকি দিতে না পারলে ওই বেঞ্চে বসে দূর থেকে তাকে দেখে মনের সাধ মেটাতে হয় ময়ূরকে।
সেলিনা এত বেশি আন্তরিক আর ব্যাকুল, মনের যেখানে বিবেক বাস করে সেই জায়গাতে ময়ূরের সমস্যা দেখা দিল। দেশের যে সুন্দর মেয়েটিকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে, তাকে সত্যি ভালোবেসেছে ও। তার বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়ার প্রশ্ন তখনও ওঠেনি। তার আগেই এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। সেলিনার সঙ্গে সম্পর্কের শুরুতে ওর প্রচ প্রার্থনা ছিল_ দেশে যেন এই খবর না পেঁৗছায়, অন্তত মেয়েটির কানে যেন কিছু না যায়। কিন্তু ময়ূর জানে, একজন মানুষ যতই সাবধান হোক, ভাগ্য কখন যে কাকে নিয়ে নির্দয় খেলা শুরু করবে কেউ তা আগে থেকে বলতে পারে না। দুনিয়াটা অসম্ভব ছোট বলে রাগ হতে লাগল ওর। দেশের ছেলে প্যারিসে কম নয়। অনেকে আর্ট কলেজে পড়ছেও। তারা যে কোনো সময় ছবি আঁকতে ঢুকে পড়তে পারে নটর ডেম চার্চে। চার্চ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে পার্কে, কিংবা নিচু আর বিষণ্ন চেহারা নিয়ে একধারে দাঁড়িয়ে থাকা হাসপাতালের ওই মর্গেও ঢুকে পড়তে পারে। সাবজেক্ট হিসেবে মর্গকে কেউ বাছাই করলে কারও কিছু বলার আছে? তাদের মধ্যে এ রকম একজন থাকা বিচিত্র নয়, যে ওকে আর দেশের সুন্দর মেয়েটিকে চেনে। তারপর একটা ই-মেইল কিংবা এসএমএস যথেষ্ট ওর সর্বনাশ করতে।
সরল সাধারণ একজন তরুণ ময়ূর, যে সব সময় ঝামেলা আর সমস্যা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে, এবং সম্ভবত অন্তর থেকে ওকে সাবধান করা হচ্ছে যে খুব তাড়াতাড়ি একটা সংকটের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। কাজেই অনিচ্ছুক বিবেক ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিতে শুরু করল।
এই সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান দেখতে পায় না ময়ূর। তাই মাঝেমধ্যে ভেবেছে, প্যারিসের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো কলেজে ভর্তি হবে কিনা। কিন্তু সেলিনা যদি নাছোড়বান্দার ভূমিকা নেয়, ওর এখনকার কলেজ থেকে তখনকার কলেজের ঠিকানা ঠিকই সংগ্রহ করতে পারবে, আর বর্তমান কলেজকে সমস্ত তথ্য না জানিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি হওয়া ফ্রান্সে অন্তত সম্ভব নয়। ছেলেমানুষি আরেকটা চিন্তা :আঁকা শেখা বাদ দিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া যাক। সেটা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিল ময়ূর। ও কি একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ফ্রান্সে আসেনি? ওকে কি বড় শিল্পী হতে হবে না?
ব্যাখ্যা দিয়ে সর্বনাশা ধস নামিয়ে আনার জন্য বহুবার স্নায়ু শক্ত করেছে ময়ূর, কিন্তু সময় আসতে মনোবল ধরে রাখতে পারেনি। এক পর্যায়ে কথাটা বলতেই হলো ওকে। প্রথমদিকে সেলিনাকে পরিস্থিতি বোঝাতে একটু সমস্যায় পড়ল। শেষ পর্যন্ত সবই বুঝল ওর সঙ্গিনী, অথচ তারপরও কোনো দৃশ্য তৈরি হলো না। সেলিনা শুধু কাঁকরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল, এবং ধীরে ধীরে ময়ূরের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল নিজের হাত। ওকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি কাঁদল না, এমনকি ওর প্রশ্নের উত্তরও দিল না। শুধু নিঃশব্দ পায়ে চার্চের ছায়ায় পায়চারি করতে লাগল। ওর হৃদয়ের যে জায়গাটিতে সেলিনা আছে, ময়ূর তাকে জানাল, অন্য কেউ কখনও সেটি দখল করতে পারবে না। প্রথম মেয়েটির সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু সেলিনার সঙ্গে পরিচয় হবার আগে ওর জানা ছিল না প্রেম জিনিসটা আসলে কী। ছেঁড়া যাবে না এমন বাঁধনে ওই মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ও_ কথাটা পুরোপুরি সত্যি। কারণ ওই সুন্দর মেয়েটির বাবা একজন ধনী মানুষ। ভবিষ্যতে ভালোবাসাহীন যে করুণ জীবন ওকে বয়ে বেড়াতে হবে, সে সম্পর্কে বিশদ ধারণা দিল সেলিনাকে। তখন নিজের প্রতি করুণার একটা সুনামি অনুভব করল ও। ওর গলার আওয়াজ কেঁপে গেল। ওদের এই বিচ্ছেদ অত্যন্ত শান্তভাবে মেনে নেয়ায় সেলিনার প্রতি খানিকটা ক্ষোভ জাগল মনে। আহত বোধ করছে। ভাবছে, তার সেই আবেগের বন্যা এক নিমেষে শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেল কীভাবে। একজন পুরুষের সবচেয়ে প্রিয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়ে গেলেও সে অতৃপ্ত থাকে। মনে মনে ময়ূর আশা করেছিল, সেলিনা যেন ঠিক এভাবেই ব্যাপারটা মেনে নেয়।
সব জিনিসই এক সময় শেষ হয়, শেষ হলো ব্যাখ্যাটাও।
'
তো ঠিক আছে, সেলিনা, শুভ বিদায়'_ বলল ময়ূর। বাড়িয়ে দিল নিজের হাত। এক মুহূর্ত ইতস্তত করল সেলিনা। তারপর মুখ না তুলে নিজের তালু রাখল ওর তালুর ওপর।
এভাবে কিছুক্ষণ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকল ওরা। পাশের ফোয়ারা মিষ্টি সুরে কলকল করছে। কাঁকরের ওপর দিয়ে একটু একটু করে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে চার্চের ছায়া। পার্ক খালি হয়ে গেছে, শুধু ওরা দু'জন ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। আলতো করে হাতটা টেনে নিতে চেষ্টা করল সেলিনা, কিন্তু ময়ূর ছাড়ছে না।
'
আমাকে তোমার কিছু বলার নেই, সেলিনা?' জানতে চাইল ও। গলার সুরে মৃদু তিরস্কার, হয়তো বা ক্ষীণ একটু অভিমানও।
সেলিনা উত্তর দিল না। তার আঙুলগুলো ধরে আছে ময়ূর। পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে ওর মুঠো থেকে। ছায়াটা লম্বা হয়ে সেলিনার পা স্পর্শ করল।
'
সেলিনা, তুমি অন্তত একটা চুমো খেয়ে বিদায় জানাতে পারো আমাকে?'
দ্রুত নিজের হাতটা টেনে নিল সেলিনা। মাথা নাড়ল, তারপর ময়ূরের দিকে পেছন ফিরল। চোখে পলক পড়ছে না। সেলিনাকে যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে থাকল ময়ূর। ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হওয়ার পর অসম্ভব ক্লান্ত শরীর আর শূন্য একটা মন নিয়ে নিজের ঘরে ফিরছে বেচারা।
নিজের ওপর রেগে আছে ময়ূর। সেলিনা হতাশ করেছে ওকে। এত বুদ্ধিমতী আর সপ্রতিভ মেয়ে, যার রসবোধ এত প্রখর, তার কাছ থেকে এমন কিছু একটা শুনবে বলে আশা করেছিল, যা ওর কাছে খুব মূল্যবান বিবেচিত হবে। তাতে ওর সততার প্রশংসাও থাকবে। কিন্তু কোথায় কী! ওর ধারণাই ছিল না_ মেয়েটির আসলে হৃদয় বলতে কিছু নেই। এরপর দেশে রেখে আসা ওর সেই সুন্দর মেয়েটির কথা ভাবল ময়ূর। ওই মেয়ের চরিত্রেও সৎ একজন তরুণকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়ার মতো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমদিকে প্রতিদিন ফেসবুকে যোগাযোগ হতো। সেটার সংখ্যা কমে মাসে-দু'মাসে একবার দাঁড়িয়েছে। এখানে কী ঘটছে তা তার কানে গেছে বলে মনে হয় না। গেলে প্রসঙ্গটা অবশ্যই তুলত সে। তবে এও ঠিক যে, কথা উঠলে সরাসরি অস্বীকার করা যাবে না। এটা ওকে দেশে ফিরে ব্যাখ্যা করতে হবে।
বুলেভার্দ সেইন্ট জারমেনে, ওর নিজের ঘরে, একটা ব্যাখ্যা অপেক্ষা করছিল। এনভেলাপে জাপানের ডাকটিকিট, তবে হাতের লেখা অতি পরিচিত, ওর সেই দেশের সুন্দর মেয়েটির। একটা ভুল করা হয়ে গেছে, লিখেছে মেয়েটি। তবে সুখের কথা এই যে, বেশি দেরি হওয়ার আগেই সেটা ধরা পড়েছে তার চোখে। অত্যন্ত তিক্ত ভাষায় নিজেকে তিরস্কার করেছে সে। তা করতে গিয়ে তিন পৃষ্ঠা জায়গা নিয়েছে। তারপর চতুর্থ পৃষ্ঠায় এসে ময়ূর বুঝতে পারল এই চিঠি ওর হাতে পেঁৗছুনোর আগেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, এবং এখন সে স্বামীর সঙ্গে হানিমুন করছে জাপানে।
চিঠিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করছে ময়ূর, আর গালমন্দ করছে মেয়েটিকে। বিশ্বাসঘাতিনী! নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে হেসে উঠল। কর্কশ লাগল আওয়াজটা। তারপর ওর চিন্তা ঘুরে গেল সেলিনার দিকে। এটা নির্মম একটা পরিহাস যে সেলিনা ধনী পরিবারের মেয়ে নয়। আরও অনেকের মতো ময়ূরও উপলব্ধি করে, যারা মেধাবী, বড় কিছু হতে চায়, তাদের দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করা চলে না। হঠাৎ ওর মনে হলো, সেলিনার পরিবার গরিব তো নাও হতে পারে। বিষয়টা নিয়ে যত চিন্তা করল ততই বিস্মিত হলো। সেলিনা ধনী পরিবারের মেয়ে নয়_ এটা সে কীভাবে নিশ্চিত ভাবে ধরে নিয়েছিল! সেলিনা দামি কাপড়চোপড় পরে, দামি ফোন ব্যবহার করে। তাকে মাঝেমধ্যে কিছু গয়নাও পরতে দেখেছে, দামি পাথর বসানো। ব্যাখ্যাটা একদিন পরে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে খুব ভালো হতো। তবে এর সহজ একটা সমাধানও আছে। সেলিনাকে বলা হবে, তাকে পাবার জন্য দেশের মেয়েটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে। হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ময়ূর_ সেলিনার ঠিকানা জানা নেই ওর, এমনকি ওদের পরিবারের নাম পর্যন্ত কখনও শোনেনি।
নিজেকে অভয় দিল, প্রার্থনার জন্য আবার তো চার্চে তাকে আসতেই হবে। নিশ্চয় ওই পার্কেও একবার ঢুকবে সে। ওখানে ঘুর ঘুর করবে ময়ূর, যতদিন না তার দেখা মেলে। অন্তত আজ রাতে কিছুই করার নেই ওর।
সকালে ফেসবুক খুলতেই সেলিনার মেসেজ দেখতে পেল ময়ূর, কাল রাতে লিখেছে। রুদ্ধশ্বাসে পড়ার পর আনন্দটা নেশার মতো পেয়ে বসল ওকে। চার্চের পেছনে আরেকবার ওর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে সেলিনা।

'
আজ আমি তোমাকে বলতে পারিনি,' লিখেছে সে। 'আমি শুধু অনুভব করেছি কাল তুমি সব জানতে পারবে, যদি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করো। ভয় পেয়ো না যে আমি তোমাকে তিরস্কার করব। জানি, তুমি খুব ভোরে ফেসবুক খুলবে। দুপুর ঠিক বারোটায় ফোয়ারার দক্ষিণ দিকে থাকব আমি, তেরো নম্বর বেঞ্চে। তেরো নম্বর বেঞ্চ, চার্চ থেকে সবচেয়ে দূরে। সেলিনা।'

ভাগ্যের এ রকম সহায়তা পেয়ে নিজেকে পরম সুখী একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে ময়ূরের। অনুভব করছে, আসলে এত বড় একটা স্বর্গীয় উপহার পাওয়ার উপযুক্ত পাত্র নয় সে। ওই জায়গায় সময়ের কিছু আগেই পেঁৗছে গেল। সারির শেষ বেঞ্চটাই তেরো নম্বর হবে, ফোয়ারার দক্ষিণে। সেলিনা এখনও এসে পেঁৗছুয়নি, তবে বারোটা বাজতে এখনও আধ ঘণ্টা বাকি। সকালের কাগজ কিনে পড়ছে আর অপেক্ষা করছে ময়ূর। অবশেষে ঢং ঢং করে ওর চারদিক থেকে চার্চের বেল বাজার আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করল। বারোটা বাজে। সেলিনা আসেনি। এটা স্বাভাবিক নয়, তবে সব সময় সম্ভব। সে হয়তো পালাবার সুযোগ করতে পারেনি। পনেরো মিনিট পার হলো, তারপর আধ ঘণ্টা। ময়ূর এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছে, একটা প্র্যাকটিক্যাল জোকের শিকারে পরিণত হয়েছে ও। তবে পরক্ষণেই বাতিল করল চিন্তাটা। এ রকম কিছু এই মেয়ে কক্ষনো করতে পারে না। ছোট পার্কের ভেতর ছটফট করছে ও। ভাবছে, বেঞ্চের সারি চিনতে ভুল করেনি তো? কিন্তু না। পার্কের কোথাও সেলিনা নেই। মোবাইল ফোন বের করে আবার ফেসবুক খুলল। পরিষ্কার লেখা আছে_ তেরো নম্বর বেঞ্চ। চার্চের দিক থেকে শুরু হওয়া বেঞ্চগুলো গুনতে শুরু করল_ এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো। সারিতে বেঞ্চ মাত্র বারোটা।
বারো নম্বর বেঞ্চের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে ময়ূর। ওর পাশ থেকে এক লোক বলল, 'এই বেঞ্চটাই, মশিয়ে।'
'
মানে! কী বলতে চান আপনি?' প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ময়ূর। ঘুরে যাচ্ছে তার দিকে, এ রকম একটা মন্তব্য শুনে হতচকিত।
'
ওই বেঞ্চেই কিশোরী মেয়েটিকে আজ সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বোধহয় বিষ খেয়েছে, ওরা বলাবলি করছিল।'
তার দিকে তাকিয়ে থাকল ময়ূর, তারপর খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করল, 'মেয়েটি...কে?'
'
এখনও কেউ জানে না। তবে জানা যাবে। কারণ যে শুনছে সে-ই মর্গে গিয়ে দেখে আসছে তাকে। আজ ওই বেঞ্চে সে একা। বেশি ভিড় হবার আগে এখনই একবার দেখে আসতে পারেন। আমি দু'বার গেছি।'
বারো নম্বর বেঞ্চে ধপাস করে বসে পড়ল ময়ূর। হাত রাখল কপালে। এখন বুঝতে পারছে, সেলিনা ওর জন্য তেরো নম্বর বেঞ্চে অপেক্ষা করছেচার্চ থেকে সবচেয়ে যেটা দূরে!
সূত্র: সমকাল-কালের খেয়া- ০৬.০৯.২০১৩


No comments: