Tuesday, June 25, 2013

তদন্তের খসড়া - মা সু দ আ নো য়া র



পুরো ব্যাপারটা যেভাবে ঘটা উচিত, সাকিব আর শ্যামলীর বেলায় তা-ই ঘটেছিল। শ্যামলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির এক্সিকিউটিভ; সাকিব অল্প বয়সেই নামকরা একটি দৈনিকের ডাকসাইটে বার্তা সম্পাদক। সুতরাং মাস ছয়েকের চুটিয়ে প্রেমের পরিণতি পরিণয়ে গিয়ে ঠেকতে বাধেনি কোথাও।
মোটামুটি ধুমধামের মধ্য দিয়েই দুই পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছে তাঁদের। মধুচন্দ্রিমা কাটাতে হনলুলু কিংবা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি দুজনেরই ছিল। কিন্তু ওসব জায়গায় না গিয়ে এক মাসের ছুটিতে রাঙামাটিতে গিয়েছিলেন তাঁরা। বন্ধুদের প্রশ্নকক্সবাজারের বদলে রাঙামাটিতে কেন? দুজনেরই জবাব, নীল পাহাড়ের নিবিড় রহস্য যেমন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও তেমন হওয়া উচিত। বন্ধুরা এর বেশি আর ঘাঁটায়নি।

এক মাস সময় আর লাগেনি। তার আগেই ফিরে এসেছেন দুজন। না, দুজন নয়, একজন। সাকিব। আসলে সাকিবও নয়। সাকিবের লাশ। আর শ্যামলী গ্রেপ্তার হয়েছেন খুনের আসামি হিসেবে।
সাকিবের পত্রিকা দৈনিক জাগরণ-এর ক্রাইম সেকশনের তরুণ রিপোর্টার শোয়েব সাঈদ সাকিব-হত্যা নিয়ে রাঙামাটি থেকে পাঠানো গৌরকিশোর চাকমার রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন।
রাঙামাটি থেকে সাকিবের নিহত হওয়ার খবর প্রথম যখন অফিসে আসে, তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন আগারগাঁওয়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মিন্নত আলীর একমাত্র ছেলেকে অপহরণ ও ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে পাঠানোর ঘটনা নিয়ে। রাইট-আপটা দারুণ দাঁড় করিয়েছিলেন। নিজে প্রতিভাবান, তাতে নিউজ এডিটর সাকিবুল হকের পরিচর্যা পেয়ে তরতর করে উঠে এসেছেন শোয়েব। তা ছাড়া ওপর মহলে বাবার পরিচিতির সুবাদে আর নিজের আন্তরিক খাটাখাটুনির কারণে কিছু সোর্সটোর্সও দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। এদিকে ডিএমপির এডিসি কাজী জিয়ার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু। ঢাকা শহরের অপরাধজগতের নাড়ি-নক্ষত্রের হদিসও মোটামুটি পাচ্ছেন কিছু।
সাকিব হত্যাকাণ্ডের খবর অফিসে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে শোয়েবকে। আগারগাঁও-অপহরণ রিপোর্টের দারুণ রাইট-আপটা অসমাপ্ত রেখেই শিফট ইনচার্জকে ইনফরমেশনগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসেন তিনি। রাতে ভাত খেতে পারেননি। সাকিব ভাই কেবল ওর নিউজ এডিটরই নন, ওঁর গাইডও। নববাণীতে ওঁর কয়েকটা রিপোর্ট দেখে সাকিব ভাই-ই ওঁকে নিয়ে এসেছিলেন দৈনিক জাগরণ-এ। সেই সাকিব ভাইয়ের মতো তরতাজা যুবক খুন হয়ে গেলেন বিয়ে করার পর এক মাস না পেরোতেই! ভাবতেই মাথা খারাপের উপক্রম শোয়েবের।
গৌরকিশোর তাঁর রিপোর্টে পুলিশের স্টেটমেন্ট নিয়েছেন। পুলিশ বলছে, সাকিব ভাইকে শ্যামলী ভাবিই খুন করেছেন। ঘটনার সময় ওই পাহাড়ে সাকিব আর শ্যামলী ছাড়া কেউ ছিলেন না। সুতরাং খুন করতে চাইলে শ্যামলীর জন্য ওটাই ছিল সবচেয়ে সহজ উপায়। পাহাড়ে পাথরের অভাব নেই। গল্প করতে করতে শ্যামলীর পক্ষে সাকিবকে পেছন থেকে পাথরের আঘাতে অজ্ঞান করে তারপর ঠেলে হ্রদের পানিতে ফেলে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
কিন্তু শ্যামলী কেন তাঁর নববিবাহিত প্রেমিক-বরকে খুন করবেন, সে প্রশ্নের জবাবে পুলিশের অনুমান, তাঁদের মধ্যে হয়তো কোনো ব্যাপারে মনকষাকষি হয়েছিল এবং তাতে ক্রোধের বশে শ্যামলীর পক্ষে সাকিবকে খুন করা অস্বাভাবিক নয়। গৌরকিশোরকে পুলিশের বড় কর্তা আশফাকুর রহমান নাকি বলেছেন, আরে ভাই, ফ্যাক্টস আর স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। পড়েননি?
গৌরকিশোর রাঙামাটির যে মোটেলে সাকিব ভাইয়েরা উঠেছিলেন, সে মোটেলের ম্যানেজারের বক্তব্যও নিয়েছেন। ম্যানেজার তেমন কিছু বলতে পারেননি। তিনি বা তাঁর কর্মচারীরা সাকিব-শ্যামলীর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি। তবে যেদিন সাংবাদিক সাহেব খুন হন, সেদিন সকালে মোটেল থেকে বেরোনোর সময় দুজনের মধ্যে খুব হাসিখুশি ভাব ছিল না, এটা তিনি খেয়াল করেছেন। না, ঝগড়া-বিবাদ বা মনোমালিন্যের কোনো আঁচ অবশ্য তাঁরা পাননি।
গৌরকিশোর লিখেছেন, শান্তি বাহিনী চাঁদার জন্য কাজটা করতে পারে। পুলিশও আশঙ্কাটা নাকচ করে দেয়নি। ওদিকে মোটেল ম্যানেজার নিজেও সে ভয় করেছেন। কিন্তু শোয়েব এ ব্যাপারে একমত হননি ওদের সঙ্গে। শান্তি বাহিনী চাঁদার জন্য খুন করবে না। খুন না করে অপহরণ করলেই তাদের লাভ। সাকিব ভাই ও শ্যামলী ভাবি দুজনকে অপহরণ করে ১০-২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করলে সেটা পূরণের আশা তারা করতেই পারত। সেটা না করে অনর্থক অচেনা একটা মানুষকে খুন করতে যাবে কেন তারা?
এদিকে পুলিশের জেরার জবাবে শ্যামলী ভাবি শুধু বলেছেন, আমি কিছু জানি না। আমি আর সাকিব পাহাড়ে উঠে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। তারপর দুষ্টুমি করে লুকোচুরি খেলতে শুরু করি। আমি একটা ঝোপের আড়ালে লুকোই। সাকিব আমাকে খুঁজতে শুরু করে। অনেকক্ষণ ধরে ওর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি বেরিয়ে আসি। নিজেই ওকে খুঁজতে শুরু করি। ওর নাম ধরে ডাকি। শেষে সাম্পান-মাঝিসহ ওকে খুঁজে পাই পাহাড়ের নিচে হ্রদের মধ্যে। ও তখন মারা গেছে। ও সাঁতার জানত না। আমার মনে হয়, আমাকে খুঁজতে গিয়ে পাহাড়ের একদম প্রান্তে চলে যাওয়ায় পা ফসকে পড়ে যায়। আমি কিছু টের পাইনি।
বোঝাই যায়, শ্যামলী ভাবির কথা বিশ্বাস করেনি পুলিশ। তারা তাঁকে অ্যারেস্ট করে কোর্টে চালান করে দিয়েছে। সেখান থেকে জেলহাজতে।
রিজার্ভ বাজারের বাংলাদেশ হোটেলের কেবিনে বসে গৌরকিশোর চাকমাসহ সকালের নাশতা সারছেন শোয়েব। অফিস থেকে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় রাঙামাটি এসেছেন শোয়েব। সাকিবুল হক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় প্রতিনিধি গৌরকিশোরের রিপোর্টে তাঁর কৌতূহল মেটেনি। তিনি নিজে ক্রাইম রিপোর্টার। ক্রাইমের ওপর তাঁর বেশ কিছু বহুল আলোচিত রিপোর্ট রয়েছে। গত বছর ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে জোড়া খুনের ব্যাপারে তাঁর রিপোর্টের সূত্র ধরে পুলিশ শেষ পর্যন্ত খুনি চক্রের সন্ধান পেয়েছিল। বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল তখন। সাকিব ভাই ওঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, মনে হয় মিডিয়ার চেয়ে পুলিশে আরও ভালো করতে পারতি রে শোয়েব। গোয়েন্দা পুলিশে নাম লেখাবি কি না ভেবে দেখ।
গৌরকে সঙ্গে নিয়ে যে পাহাড়ে সাকিব ভাই খুন হন, প্রথমে সে পাহাড়ে গেলেন শোয়েব। নির্জন পাহাড়টা। আশপাশের টিলায় চাকমাদের ঘরবাড়ি থাকলেও এই টিলায় ঘরবাড়ি নেই। পুরো টিলাটি ন্যাড়া বলতে গেলে। ছোট বুনো ঝোপঝাড়, বিশাল বিশাল কয়েকটা সিবিট গাছ আর রামকলার ঝাড়। দেখার মতো আছে কেবল একটা ঝরনা, অনেক উঁচু থেকে নেমে এসেছে। স্বচ্ছ, নীল পানি। দেখার জন্য রাঙামাটিতে এর চেয়ে ভালো অনেক জায়গা আছে। তবু সাকিব ভাই আর শ্যামলী ভাবির এখানে আসার আগ্রহ কেন হলো, বুঝতে পারছেন না সে। তা ছাড়া রাঙামাটি শহর থেকে পাহাড়টার দূরত্বও নেহাত কম নয়। সাকিব ভাইকে নিয়ে নানা কথা বলছিলেন গৌর।
গৌরকিশোরের কাছে কিছু প্রশ্নের জবাব চেয়েছেন শোয়েব। সাকিব ভাই খুন হওয়ার সময় তাঁদের ওই পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া সাম্পান-মাঝি কোথায় ছিলেন? তিনি কি ওই পাহাড়ের কাছে অপেক্ষা করছিলেন? শ্যামলী ভাবি বলেছেন, সাম্পান-মাঝিসহ তিনি সাকিবের লাশ খুঁজে পেয়েছেন পানিতে। সুতরাং ধরে নেওয়া যাক, সাম্পান-মাঝি পাহাড়ের কাছেই ছিল এবং শ্যামলী ভাবি তাঁকে ডাকামাত্র পেয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, খুনি সাকিব ভাইকে খুন করতে ওঠার সময় তিনি টের পাননি কেন? ওই পাহাড়ে কি তাহলে খুনি আগে থেকেই বসে ছিল? সাকিব ভাই আর শ্যামলী ভাবি যে সেদিন ওই পাহাড়েই যাবে, সে কি তাহলে জানত? গৌর এর জবাব দিতে পারেননি।
সাম্পান-মাঝির নাম শামসু। রিজার্ভ বাজারের সিঁড়িঘাটায় যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন লোকটা। শোয়েব তাঁর কাছে গেলেন। গৌরকিশোরকে সঙ্গে নেননি। দূর থেকে ওঁর সাম্পানটা দেখিয়ে দেওয়ার পর গৌরকে চলে যেতে বলেছেন।
সাম্পানের রঙের মতোই কালো লোকটা। স্বাস্থ্যবান। বসন্ত রোগের দগদগে দাগ মুখে। একটা চোখ কিছুটা ঘোলাটে। অন্যটা পরিষ্কার কালো। গোল মুখে চ্যাপ্টা নাক আর তার নিচে থ্যাবড়া দুই ঠোঁট।
সাম্পানের দাঁড়ে ক্যাঁক্কোরোত্ শব্দ তুলে যাত্রী ডাকছিলেন লোকটা। কাপ্তাই...সুবলং...বুড়িঘাট...। শোয়েব সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পান খাওয়া লাল দাঁত দেখিয়ে হাসলেন। যাইবাননি সাব...কাপ্তাই...সুবলং...বুড়িঘাট...।
হাসলেন শোয়েবও। হুঁ, সুবলং যাব। ভাড়া কত?
আরে, আইয়েন। আমনেরা সাব মানুষ। আমনের গো লগে কিয়ের দরদাম?
না। আগে ভাড়া ঠিক করো।
দিয়েন ১০০ টাকা। আপ-ডাউন হলে ২৫০।
হ্যাঁ, আপ-ডাউন। যাব আবার আসব।
ছার, কই থাইকা আইছেন? ঢাকা থাইকা?
না, রাজশাহী থেকে। কেন?
না না, এমনি জিগাইলাম। তয় উডেন ছার।
সাম্পান পুব দিকে চলল। অবিরাম শব্দ হচ্ছে ক্যাঁক্কোরোত্...। শব্দটার মধ্যেও এক ধরনের ছন্দ। অভ্যস্ত হাতের কারিগরিতে দুই পাশে কাঠের দুটো দাঁড়ের পাতা পেছন দিকে উল্টে দিচ্ছে পানি। তারই প্রতিধাক্কায় রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে এগোচ্ছে সাম্পান। রাঙামাটি ফাড়ি আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে পুবের পাহাড়গুলোর দিকে যাচ্ছে। মাঝি গান ধরেছেন, সূর্য উডেল্লে ভাই লাল মারি/লুসাই পাহাড়ত্তুন নামিয়েরে/যারগৈ কর্ণফুলী...। বোঝাই যাচ্ছে, মনে বেজায় ফুর্তি লোকটার।
মাঝি ভাই, সাম্পান বাইছ কত দিন ধরে? লোকটার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছেন শোয়েব।
সাম্পান মাঝি হাসলেন। বোঝা গেল, তিনিও কথা বলার জন্য মুখিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। কিন্তু সাহেবের মুড অফ দেখে মুখ খোলেননি।
তা অইব পেরায় বছর বিশেক। সাব, কোতায় উটেছেন? হোটেলে, নাকি মোটেলে?
আজ সকালেই তো আসলাম। দেখি হোটেলে...আচ্ছা, ভালো একটা হোটেলের নাম বলো তো?
ভালা হোটেল আর কই পাইবেন? সবখানেই তো হইচই...হট্টগোল। তার চেয়ে মোটেলে উডেন।
মোটেল?
হ্যাঁ, ছার। বনরূপার মোটেল নিবিড় নীলিমা এখানকার সবচেয়ে ভালা মোটেল।
ওরে বাবা! মোটেলে তো অনেক টাকা নেবে।
আমি কইয়া দিলে অনেক কম নিব।
তুমি বললে কম নেবে? তুমি তো সামান্য সাম্পান-মাঝি, মোটেল তোমার কথা শুনবে?
ছার, সাম্পান-মাঝি বলি ঘৃণা করেন, ঠিক আছে। কিন্তু আমরা কথা কইলে... থেমে গেল। সামান্য সাম্পান-মাঝি বলায় মাইন্ড করেছেন লোকটা।
প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর। সাম্পান এখন কাইন্দা পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে যাচ্ছে। এই টিলায় খুন হয়েছিলেন সাকিব ভাই। টিলাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন শোয়েব। শান্ত নির্জন টিলা। মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। পাখপাখালির দু-একটা ডাক শোনা যাচ্ছে মাত্র। বোঝাই যাবে না, মাত্র দিন পনেরো আগে এখানে একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। সাকিব ভাইকে প্রাণ হারাতে হয়েছে আর শ্যামলী ভাবিকে রাঙামাটির জেলখানায় পচে মরতে হচ্ছে।
শামসু, সাম্পান মাঝিকে ডাকলেন শোয়েব।
জি ছার? সাড়া দিলেন সাম্পান-মাঝি। কৌতূহলী চোখে চাইলেন। পরক্ষণে মুখের ভাব পাল্টে গেল লোকটার। সরু চোখে চাইলেন। আমনে আমার নাম জানলেন কেমনে? শোয়েব তাঁর কথার জবাব না দিয়ে বললেন, এই টিলাটায় একটু নামব।
এই টিলায় নামবেন? কেন?
আহ্, থামো তো? এত প্রশ্ন করছ কেন?
এই টিলায় নামা যাবে না। এইখানে শান্তি বাহিনীর ভয় আছে। কদিন আগে একজনরে মারছে। ঢাকা থেকে আইছিল বউ লইয়া। বেডারে মারি বউডারে ধরি লই গেছে। পেপারে পড়েন নাই? আমনেরা শিক্ষিত মানুষ...।
জোরে জোরে দাঁড় বাইতে শুরু করলেন শামসু মাঝি। রাজশাহী থেকে আসা ওঁর প্যাসেঞ্জার কী করে ওঁর নাম জানলেন, দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন না। সুবলং পৌঁছে বললেন, আপ-ডাউন যামু না, ছার। আমনে আঁর ভাড়া দিয়া দেন।
শোয়েব ওঁর ভাড়া মিটিয়ে দিল।
বনরূপা। মোটেল নিবিড় নীলিমায় ঢুকতে গিয়ে লোকটার দিকে চোখ পড়ল শোয়েবের। হন হন করে বেরিয়ে আসছেন। শোয়েবকে খেয়াল করলেন না। লোকটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, একই সঙ্গে ভীত ও বিরক্ত। দামি সুতির লুঙ্গিটায় ফাঁত্ ফাঁত্ শব্দ তুলে শোয়েবের প্রায় গা ঘেঁষেই গেটের বাইরে চলে গেলেন।
অবাক হলেন শোয়েব। নিবিড় নীলিমার মতো অভিজাত একটি মোটেলে একজন সাম্পান-মাঝির কী কাজ? গতকাল লোকটা তাঁকে নিবিড় নীলিমায় ওঠার জন্য সেধেছেন। বলেছেন, ভাড়া বেশি মনে হলে তিনি বলেকয়ে কমিয়ে দিতে পারবেন। তার মানে কি লোকটা নিবিড় নীলিমার খদ্দের ধরার দালাল? খদ্দের এনে দিতে পারলে কমিশন পান? কিন্তু এমন অভিজাত মোটেলের খদ্দের ধরার দালাল একজন সাম্পান-মাঝি হয় কী করে?
মোটেলের ম্যানেজার খাটো চেহারার ফরসা লোক। বয়স বছর চল্লিশ। গোঁফ-দাড়ি কামানো পরিচ্ছন্ন চেহারা। ভুরু কুঁচকে আগন্তুকের দিকে তাকালেন। নিজের পরিচয় দিলেন সাকিব। সঙ্গে সঙ্গে যেন আগুনের মতো ঝলসে উঠলেন ম্যানেজার। কী পেয়েছেনটা কী আপনারা? সাংবাদিক হয়েছেন বলে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি? আপনার লোক আমার মোটেলে খুন হয়নি। খুন হয়েছে কাইন্দার পাহাড়ে। যান, সেখান গিয়ে খোঁজ করুন গিয়ে। কেউ নিষেধ করবে না। আমাদের জ্বালাতে এসেছেন কেন?
এ রকম আপ্যায়ন আশা করেননি সাকিব। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন তিনি। মিন মিন করে বললেন, ভাই, আপনি রাগ করছেন কেন? আমি তো আপনাকে খারাপ কিছু বলিনি। আমরা সাংবাদিক মানুষ। অফিস থেকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। সেটা পালন করতে গেলে আপনাদের কাছে তো সাহায্যের জন্য আসতেই হবে। আপনারা সাহায্য না করলে...।
কেন, এর আগেই তো ওই চাকমা সাংবাদিক এসে কথা বলে গেছে। তারপর পুলিশ এসে জ্বালিয়েছে। কজনের সাথে কথা বলতে হবে? মোটেল খুলে অপরাধ করে ফেলেছি নাকি? এভাবে সারাক্ষণ খুনখারাবির খোঁজখবর নিতে এলে আমরা কাস্টমার পাব? একজন রুমবয়ের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন, এই ব্যাটা, ২৭ নম্বর কমপ্লেন করেছে, সকাল থেকে ওই রুমের ডিশে প্রবলেম দিচ্ছে। আমাকে বলেছিলি? তারপর ফের ফিরলেন শোয়েবের দিকে। যান ভাই, ঝামেলা পাকাবেন না। যা বলেছি, পুলিশকে বলেছি। ওদের কাছে গিয়ে জেনে নিন আপনার কী জানার আছে।
যাচ্ছি। তবে দয়া করে একটা প্রশ্নের জবাব অন্তত দিন।
কী প্রশ্ন?
আচ্ছা, শামসু মাঝি কি আপনাদের খদ্দের ধরে দেওয়ার কাজ করে থাকেন? লোকটা বলেছিলেন আপনাদের...।
ক্কী বলেছে...আরে ধ্যাত্ মিয়া, কোথাকার কোন শামসু মাঝি? যান তো যান, ভাগেন।
রাঙামাটি থেকে ফিরে এসে অফিসে যোগ দেননি শোয়েব। ওঁর ছুটি শেষ হওয়ার আরও দুই দিন বাকি। সকালে উঠে পত্রিকার পাতা উল্টে রাঙামাটি প্রতিনিধির পাঠানো ছোট্ট নিউজটা প্রথম পাতায় চোখে পড়ল ওঁর। শামসু মাঝি নামের একজন সাম্পান-মাঝির লাশ পাওয়া গেছে গতকাল বুড়িঘাটের কাছে আম্বুরিপাড়া নমের এক জায়গায়। লোকটাকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। পুলিশের সন্দেহ, কাজটা শান্তি বাহিনীর। ওর সাম্পানটা ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। রাঙামাটি প্রতিনিধি লিখেছেন, জাগরণ-এর বার্তা সম্পাদক সাকিবুল হকের খুন হওয়ার কথা এই লোকটিই জানিয়েছিলেন পুলিশকে।
গৌরকিশোরকে ফোন করলেন শোয়েব। কিছুক্ষণ আলাপ করে নিলেন তাঁর সঙ্গে। তারপর বেরোলেন। ওঁর গন্তব্য ডিএমপি এডিসি কাজী জিয়ার অফিস।
চুপচাপ সাকিবের কথা শুনলেন জিয়া।
তুই কি কাউকে স্পেসিফিক সন্দেহ করছিস? চায়ের কাপ ঠক করে টেবিলের ওপর রেখে প্রশ্ন করলেন।
আমার সন্দেহের তালিকায় আছে সাম্পান-মাঝি শামসু মিয়া, মোটেল নিবিড় নীলিমার ম্যানেজার আবদুল বাসেত আর...। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন শোয়েব। তোদের ওই পুলিশ কর্মকর্তা আশফাকুর রহমান।
কী?
হ্যাঁ। সাম্পান মাঝি গতকাল খুন হয়ে গেছেন। পুলিশ বলেছে, শান্তি বাহিনীর কাজ। নাহ্, সব দেখছি শান্তি বাহিনীই করছে। বুঝছি না, ঢাকার দৈনিক জাগরণ-এর নিউজ এডিটর শান্তি বাহিনীর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে তাঁকে খুন না করলে তাদের চলছিল না। লোকটাকে চিনতই না ওরা। আর যদি চিনতেই পারত, তাহলে তো উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে চাঁদা চাইলে টাকাপয়সা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। আর একটা সাম্পান-মাঝিকে খুন করে ফেলল, তাও শান্তি বাহিনী? নাহ্, একজন পুলিশ হিসেবে তুই-ই বল, অনুমান দিয়ে অপরাধী ধরা যায়?
হুম। বলে যা।
শামসু মাঝি কখনো মুখ খুলতে পারেন, এ ভয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ওঁকে। বাকি দুজন। মোটেল ম্যানেজার আর তোর ওই আশফাকুর রহমান। মোটেল ম্যানেজার সাকিব ভাইকে খুন করবে কেন? তার মোটিফ কী? নিজের ব্যবসার ক্ষতি করে অজানা-অচেনা একজন লোককে খুন করে ওঁর লাভটা কী? কিংবা লাভ আছে। হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের পুলিশের সঙ্গে হাত রাখতে হয়। হয় কি না?
তুই দেখছি চেনাজানার ওপর খুব গুরুত্ব দিচ্ছিস। তাহলে কী বলতে চাস, আশফাকুর রহমান সাকিব সাহেবকে চিনতেন?
না, চিনতেন না। তবে শ্যামলী ভাবিকে চিনতেন। লোকটা একসময় ভালোবাসতেন শ্যামলী ভাবিকে। তখন ওঁরা ইন্টারে পড়তেন ঢাকা কলেজে। বাজে আচরণ করায় কলেজ ক্যাম্পাসে শ্যামলী ভাবি ওঁকে জুতো দেখিয়েছিলেন।
তুই কী করে জানলি?
আমি কী করে জানলাম, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু যা জেনেছি, তা সত্যি কি মিথ্যে যাচাই করে দেখতে পারিস। আমার সন্দেহ সত্যি হবে, তা বলছি না। তবে আমি তোর হাতে তদন্তের একটা খসড়া ধরিয়ে দিলাম। তুই বরং আমার জানাটাকে সম্ভাবনা হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু করার ব্যবস্থা করতে পারিস কি না দেখ। তোদের আশফাকুর রহমান সাহেব বলেছেনফ্যাক্টস আর স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। আমি তাঁর কথাটাকে উড়িয়ে দিতে চাই না। তিনি আরেকটা কথা আমাকে বলেছেন। বলেছেন, শ্যামলীর মতো মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। বিচারাধীন একটা মামলায় নিজের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত সন্দেহভাজন মহিলা আসামির ব্যাপারে এ রকম মন্তব্য কোনো পুলিশের করা স্বাভাবিক কি না তুই-ই ভেবে দেখ। কথাটা অবশ্য বেফাঁসে বলে ফেলেছেন। ওখানেই আমার সন্দেহের ভিত্তি। আমি ওটাকেই পয়েন্ট হিসেবে নিয়েছি।
শ্যামলী ভাবি ঢাকা কলেজে ইন্টার পড়েছেন জানা ছিল বলেই খোঁজ নেওয়াটা সম্ভব হয়েছে। একতরফা প্রেমের ব্যাপারটা মাথায় রাখ। প্রত্যাখ্যানের জ্বালা অবশ্য আমার নেই। তোর আছে কি না জানি না। ভার্সিটিতে তো মেয়েদের যমের মতো ভয় করেছিস দেখেছি। তোদের পুলিশের শাস্ত্রেই তো আছে, খুনখারাবির ব্যাপারে মোটিফ একটা ভাইটাল জিনিস। ভেবে দেখ, একটা লোক বউ নিয়ে বেড়াতে গিয়ে খুন হয়ে গেছেন। পুলিশ স্বামী-হত্যার অভিযোগে বউটাকে অ্যারেস্ট করে চুপচাপ বসে আছে। ওরা যে মোটেলে থাকতেন, সে মোটেলে একটা প্রপার ইনভেস্টিগেশন পর্যন্ত হয়নি। মনে হচ্ছে পুলিশই চাইছে যেন মেয়েটার ফাঁসি হয়ে যায়। এটা কি দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, নাকি অবহেলা? দেখ, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের জন্য জ্বালা জুড়ানোর চেয়ে ভালো মোটিফ আর কী চাই? কেন তুই কি পুলিশকে মানুষ মনে করিস না? ওরা অপরাধ করতে পারে না? তুই ফেরেশতা বলে সবাই কি তা-ই?
 
 
সূত্র: প্রথম আলো । ১৮-০৯-২০০৯ ।


No comments: