Saturday, May 29, 2010

জনারণ্যে এক ফোঁটা ভালবাসা - মঞ্জু সরকার

জুম্মনের মা যে তার অবাঞ্ছিত গর্ভের দায় চাপানোর জন্য গোঁয়ার স্বামী ও জুম্মনসহ গোটা বিচারক সমাজকে আমার বাসায় পাঠিয়ে দেবে, ভুলেও ভাবিনি কখনো। এমন নাটকের নায়ক হওয়া দূরের কথা, দেখার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না আমি। নিরীহ ভদ্রলোক বলে সুনাম আছে। আবার বিয়েথা না করে এখনো একা আছি বলে আড়ালে হয়তো অনেকে বাদনাম গায়। কিন্তু তাই বলে লম্পট বদমাশ ভাবে না কেউ। কোনো মেয়ে এমন গাল দেয়নি, এমনকি স্বপ্নে-কল্পনায় যে সকল সুন্দরীকে উলঙ্গ করে যাচ্ছেতাই করেছি, তারাও লম্পট বলেনি। আর জুম্মনের মায়ের সঙ্গে আমার নির্জন ফ্ল্যাটে বছরখানেকের যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক, তা যতই অন্তরঙ্গ হোক, সেখানে বাস্তবে এমন কোনো মুহূর্ত এসেছিল কি, যখন মেয়েটির চোখ থেকে ছি-এর আগুন ঝিলিক দিয়েছিল? মনে পড়ে না। মেয়েটির সঙ্গে তো আমার সকল সম্পর্ক চুকেবুকেই গেছে। তাই একদিন সকালে দরজা খুলেই ছয়জন মানুষের ভিড়ে ৪/৫ বছরের জুম্মনকে দেখে চমকে উঠি।
জুম্মনের বাপকে আগে দেখিনি কখনো, চিনিও না। ভিড়ের মধ্যে একমাত্র চেনা মুখ আমাদের বিল্ডিং-এর সহভাড়াটিয়া, সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার সময় যাকে কয়েকবার দেখেছি, সালাম দিলে লোকটা গায়ে পড়ে দুএকবার কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পাত্তা পায়নি। অচেনা আগন্তুকদের সঙ্গে এই পড়শী নাকি চেনা জুম্মনকে দেখেই কি না, ঠিক জানি না, অজানা আশঙ্কায় আমার বুক একটুখানি কেঁপেও ওঠে।

কী ব্যাপার! আপনারা?

দুর্বিনীত সালাম দিয়ে জুম্মনের বাপই নিজেকে প্রথম চেনায়, আমি জুম্মনের বাপ। জুম্মনের মায়ের শরীল খারাপ, সেই পাঠায় দিছে আমারে।

কাজের মেয়ে হলেও জুম্মনের মায়ের প্রতি আমার দরদ যে আন্তরিক, সেটা লুকাবার চেষ্টা করি না। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাই, কী হয়েছে জুম্মনের মায়ের?

কী আর হইব! পেটে বাচ্চা আইছে। আপনি বলে তারে দশ হাজার টাকা দিতে চাইছিলেন?

আমি সেই গোপন মহত্ব জাহির করতে চাই না। বলি, ওর পাওনা বেতন-টেতন তো সব শোধ করে দিয়েছি।

লিগাল পাওনা ছাড়াও আপনি তারে দশ হাজার টাকা সাধছিলেন, কন দিতে চান নাই?

টাকা দিতে চেয়েছিলাম যেমন সত্য, তেমনি জুম্মনের বাপের মতো বদমাশের হাতে এক টাকাও তুলে দিতে নারাজ, সেটা বোঝানোর জন্য শক্ত গলায় বলি, দিতে চাইছি তো হইছে কী?

হ্যার প্যাট খসাইতে লাগব, সেই আমারে পাঠায় দিছে। টাকাটা দিয়া দ্যান।

যতটা রাগক্ষোভ জাগলে মানুষ চিৎকার করে, আমার ভেতরের প্রতিক্রিয়া তার চেয়েও জোরালো ও তীব্রতর হওয়ায় যাকে বলে স্তম্ভিত, ঠিক তখন পড়শী ভাড়াটিয়া সান্ত্বনা দেয়, এই টাকার বায়না নিয়ে এ বেটা তো আমার বাসাতেই আসছে প্রথম। কারণ জুম্মনের মা আমাদের বাসাতেও কাজ করত। ওই মাতারির সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, আমি তো চোখ তুলেও কখনো দেখিনি। আমার ওয়াইফ বলত, বুয়াটি ভালই ছিল। কিন্তু জুম্মনের বাপ এসব কী কথাবার্তা নিয়ে এসেছে বলেন তো! আমরা এই বিল্ডিং-এ এতগুলি ভদ্র ফেমিলি বউবাচ্চা নিয়ে থাকি, এখানকার এক ফ্ল্যাট নিয়ে এত স্ক্যান্ডাল হওয়া ভাল?

বুঝতে দেরি হয় না, জুম্মনের মায়ের পেট ফাঁদানো ও পেট খালাসের গল্পটা ইতিমধ্যে উপস্থিত সবাই জেনে গেছে। জুম্মনের মা ছেলেকে নিয়ে বোনের সঙ্গে থাকত জানতাম। স্বামী আবার বিয়ে করায় আলাদা বাসা ভাড়া নিয়েছিল সে। দুবোন বাসা-বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে নিজেদের চালানো ছাড়াও গ্রামে বাবামাকেও দেখাশোনা করত। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি মেয়েটি। তবে জুম্মনের বাপের দাবি, জুন্নুর মা আমার মতো অবিবাহিত পুরুষ মানুষের ফাঁকা বাসায় তিন মাস আগেও নিয়মিত দুই বেলা করে গেছে, সম্পর্কটা এতদূর গড়িয়েছে যে, আমি তাকে দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলাম। এখন যাতে আমি টাকা দিতে বাধ্য হই, সেই জন্য জুম্মনের বাপ দলবল নিয়ে এসেছে। এই দলের পেছনে আমার সহভাড়াটিয়া, বাড়ির কেয়ারটেকার, গার্ডসহ হয়তো গোটা সমাজের চক্রান্ত ও মদদ আছে। কিন্তু এত বড় প্রতিপক্ষকে মুহূর্তেই ভ্যানিশ করে দেয়ার ক্রোধ নিয়ে আমি বলি, এসব নোংরা বিষয় নিয়ে আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলব না। গেট আউট! আপনারা বিদায় হন।

আমি সশব্দে দরজা লাগিয়ে দেই।

দরজা লাগিয়ে ঘরে একা হতেই নিজের ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক চেহারা নিজের কাছেও ধরা পড়ে। বাইরে এক দল সন্ত্রাসী-ডাকাত আমাকে টার্গেট করেই ৫ তলায় আমার দরজা পর্যন্ত এসেছে, আর আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে পার পাব? দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে আমার বুক ঢিপ ঢিপ আওয়াজ শুনি, কিন্তু আমার উত্তেজনা ও বক্ষ-স্পন্দনকে ছাপিয়ে কানে আসে জুম্মনের বাপের চিৎকার। বদ্ধ দরজা ভেদ করে আমার কানে পৌঁছানোর জন্য স্বভাবতই তার গলা আরো চড়ে গেছে।

ঠিক আছে আমার লগে কথা না কন, আমি ঐ খানকীমাগীরে টাইনা-হেইচরা তার কামের বাড়িতে নিয়া আসুম। আপনার বাসায় আমার ওয়াইফে কাম করছে আর তারে আপনে দশ হাজার টাকা সাধছিলেন, এইটা তো অস্বীকার যাইতে পারবেন না। দরজা বন্ধ কইরা ফাঁকা বাসায় তারে কী কাম করাইছেন নিজের মুখে কইব জুম্মনের মায়। এই বিল্ডিং-এর ভদ্রলোক ছাড়াও মহল্লার গণ্যমান্য ব্যক্তিগো বিচার দিমু। স্বামী জীবিত থাকলেও গর্ভে কার বিষ ধারণ করছে, সেইটা দশজনরে ডাকায়, দরকার হয় মেডিকেল আর থানাপুলিশ কইরা প্রমাণ করুম।

জানি, লোকটার হম্বিতম্বি এখানেই শেষ হবে না। উত্তেজিত চিৎকার ও সমর্থক দলবল নিয়ে সে নিচে নেমে যায়। বদ্ধ সমাজে এই ধরনের নিষিদ্ধ রসালো গল্পের শ্রোতা ও গল্পে রং-রসের যোগানদাতা ও বয়ানকারীর অভাব হয় না। জুম্মনের মায়ের গল্প শুনতে এই ভবনে বসবাসকারী নয় ফ্ল্যাটের সব বাসিন্দাই উৎসুক হয়ে উঠবে। শোনা গল্পটা রঙরস লাগিয়ে নতুন শ্রোতার কানে পরিবেশনের দায়িত্ব নেবে অনেকেই। হয়তো ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে গেছে এই ২৭/১ নয়াটোলার ৫তলার ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া মুখচোরা ব্যাচেলর ভদ্রলোক জুম্মনের মা নামক কুৎসিত কাজের মেয়েকেও পেট ফাঁদিয়ে দেয়ার মতো বীরপুরুষ বটে। এমন সমাজবিরোধী বীরত্বের সাজা যে দশ হাজার টাকার চেয়েও বেশি হওয়া উচিত, বিচারে এ নিয়েও একমত হওয়ার জন্য জনতার আকাল হবে না এই নগরীতে।

এসব ভেবে কিংবা না ভেবেও, আমিও হঠাৎ বেশ উত্তেজিত বোধ করি। নিজস্ব গর্তে চুপচাপ নির্বিকার থাকার চেয়ে, জুম্মনের মা শ্যামার সঙ্গে প্রেম করার আনন্দ ও বেদনা যে অনেক বেশি উত্তেজক! নাকি বিচারক সমাজের কাছে ধরা পড়ার লজ্জা ও ভয়টাই ভিতরে ধকধক করছে এখনও? হঠাৎ এমন উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়াটা বিরক্তিকর। কী করতে পারবে ওরা? বাড়িঅলা থাকে আমেরিকায়। সে আমার পরিচিত জন, ব্যাচেলর জেনেও নিজের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। আমেরিকায় থাকে বলে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্য জানে সে। নিজস্ব ঘরে আমি কার সঙ্গে গোপনে লিভ টুগেদার করলাম না করলাম, এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে তার কোনো যায় আসবে না। কে কী বলছে বা ভাবছে ভেবে আমারই বা যায় আসবে কেন? এটা গ্রাম নয়, মোড়ল ডেকে বিচার বসালে সেই বিচারের রায় মানার জন্য আসামীর মতো হাজির থাকব। জুম্মনের বাপের গালে কষে একটা চড় দিয়ে যদি বলতে পারতাম, Ñ হারামজাদা, বউ তোর কিন্তু গর্ভ সৃষ্টি করে অন্য পুরুষ, আবার তার বিচার নিয়ে আসিস, তোর মতো শুয়ারের বাচ্চার বিচার হওয়া দরকার আগে! এরকম বলতে পারলেও, ওসব জন্তু-জানোয়ারের বিচার করা কি আমার কাজ? তারচেয়ে ওদের হাত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে একা থেকে, একাকিত্বের স্বাধীনতা ও বেদনা বোধ করাও অনেক আনন্দের।

জুম্মনের মায়ের গর্ভযাতনা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে, নিজের স্বাধীনতা উপভোগের জন্য আমি বিছানায় ডিগবাজি দেই, লুঙ্গি খুলে ছুড়ে ফেলি। আয়নায় নিজেকে দেখি, শালা জুম্মনের মায়ের ধর্ষকারী, নেতিয়ে আছিস কেন! ভয়ে? চারপাশের লোকসমাজে নিজের মুক্তি খোঁজার চেয়ে ঘরে বন্দি থেকে ইন্টারনেটের অসীম রাজ্যে বিশ্ব পরিব্রাজক হয়ে ঘুরতেও ভাল লাগে আমার। আমি নগ্ন অবস্থাতেই কম্পিউটার অন করি। কিন্তু এখন পছন্দসই ওয়েবপেজ খোঁজার মতো ধৈর্যসহ্য নেই। জুম্মনের মায়ের গর্ভের বিচারের উদ্বেগ-উত্তেজনা ভুলতে এখন চাই টাটকা উত্তেজনা। সিডি রোমে কিছু নিষিদ্ধ নীল ছবির ডিভিডি আছে। একটা ওপেন করলাম। মনিটরে উলঙ্গ নারী-পুরুষের শরীরী মিলনের কত যে ভঙ্গি! জুম্মনের মাকেও আর একবার নাগালের মধ্যে পেলে, গর্ভবর্তী অবস্থায়ও তাকে কতভাবে বলাৎকার করা যায়, মনিটরে চোখ রেখেও আমি মনে মনে তেমন দৃশ্যও বানাতে থাকি। আমার বীরত্বে মুগ্ধ জুম্মনের মা চেঁচাচ্ছে, ও ভাইজান, আপনি সারা জীবন আমারে আপনার ঘরে বাইন্ধা রাখেন।


সন্ধ্যায় আমার ঘরে আসে বাড়ির কেয়ারটেকার, হাসমত মিয়া। সকালে জুম্মনের বাপের নেতৃত্বে বিচারক ভিড়ের মাঝে লোকটাকে না-দেখেও সন্দেহ জেগেছিল, নেপথ্যে আছে হাসমত। এখন তাকে আসতে দেখে আমার শরীর টানটান প্রতিরোধের দুর্গ হয়ে ওঠে। হাসমত মিয়াও সরাসরি ঘটনার ভেতর থেকেই উত্তেজনা প্রকাশ করে, আমি বাড়িতে আছিলাম না, আর এই ফাঁকে হারামজাদা চিটার আইসা বলে আপনার কাছে টাকা খসাইতে আইছিল? দারোয়ান মালেকরে ধমক দিছি। এত লোকজন উপরে উঠতে দিল কেন? তিনতলার ভাড়াটিয়া লোকমান সাহেবের কাছে শুইনা ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় লাগতেছে। ব্যাপারটা কি স্যার কন তো?

ভিড়কে যেমন উপেক্ষার বর্ষা হেনে বিদায় করেছি, হাসমত মিয়াকেও একইভাবে, একটিও কথা না বলে তাড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু এই নিষিদ্ধ গল্পটায় হাসমত মিয়ার ভূমিকা আমার পক্ষে, না বিপক্ষেÑ এটা বোঝা জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা সে নাকি লোকমান মিয়াকে এইমাত্র বলে এসেছে, জুম্মনের বাপের কোনো কম্পেলেন থাকলে তা হাসমত মিয়াকেই প্রথম বলতে হবে। কারণ আমার মতো ব্যাচেলর-এর ঘর নিরাপদ ভেবেই জুম্মনের মাকে হাসমত মিয়া ঢোকার লাইসেন্স দেয়নি শুধু, আমার বাসার ঠিকা কাজের মেয়ে হিসেবে ঠিক করে দিয়েছিল। কাজেই জুম্মনের বাপে যদি এ নিয়ে তার বউয়ের কিছু বিচার করতে চায়, বিচার করতে হবে প্রথম হাসমত মিয়ার।

আমি হাসমত মিয়ার গোপন মতলব বোঝার চেষ্টা করি। বাড়িঅলার অনুপস্থিতে এ বাড়ির সব ভাড়াটিয়ার কাছেই সে বাড়িঅলার বাপ। থাকে এ বাড়ির নিচতলায়, গ্যারেজ সংলগ্ন একটি ছোটঘরে। গ্যারেজে ঘুমায় দারোয়ানও। নতুন ভাড়াটিয়া ঠিক করা, ভাড়া আদায় থেকে শুরু করে চুক্তি অমান্যকারী ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদের নোটিশ দেয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রবাসী বাড়িঅলার গ্রামসুবাদে আত্মীয়, তারচেয়ে বড় কথা খুবই বিশ্বস্ত। কিন্তু আমি যেহেতু মালিকের পরিচিত ও বন্ধুবিশেষ, এবং ব্যাচেলর হওয়ায় হাসমত মিয়ার দৃষ্টিতে এ বাড়ির ঢোকার সম্পূর্ণ অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও, বাড়িঅলার নির্দেশে তারই মালপত্র রাখা একটি ফ্ল্যাটের অর্ধেকটা ভোগদখলের অধিকার পেয়েছি, শুরু থেকেই কেয়ারটেকার হাসমত আমাকে বস ভাবতে শুরু করেছিল। তার ধারণা হয়েছিল, বাঘের ওপর ঘোগের বাসার মতো, কেয়ারটেকারের কাজে নজরদারি করার জন্য বাড়িঅলা আমাকে এ বাড়িতে নিজের ফ্ল্যাটে আমদানি করেছে। পাঁচতলার যে ফ্ল্যাটের দেড়খানা রুমে বাড়িঅলা তার কিছু মূল্যবান আসবাদপত্র রেখে তালা দিয়ে রেখেছিল। সম্পূর্ণ দুটি বাথরুম ও রান্নাঘরসহ অবশিষ্ট দেড় রুম, কেয়ারটেকার একটি ছোট ফেমিলিকে দিয়ে মাসে আট হাজার টাকা ভাড়া আদায়ের ব্যবস্থাও পাকা করে রেখেছিল। কিন্তু আমি সেই পরিমাণ টাকা মাসিক ভাড়া হিসেবে দিতে গেলে হাসমত মিয়া জিভে কামড় দিয়ে বলেছিল, কন কী স্যার, আপনার কাছে ভাড়া নিমু। আমেরিকায় সাহেব জানলে আমারে আস্ত রাখব? আমি জোর করার পরও টাকা নেওয়ার আগে সে আমেরিকার ফোনে অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে।

ভাড়া নিলেও আমি তার কাছে সন্দেহজনক রহস্যময় পুরুষ। বাসায় ঢোকার মাসখানেকের মধ্যে আমার বিয়ের ব্যর্থ ঘটকালি করতে এক বন্ধু এসেছিল, সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী। আমার কাছে আসবে শুনে হাসমত মিয়া সেই বন্ধু ও তার স্ত্রীর দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল এবং জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, ব্যাপারটা হয়তো সেই বন্ধু আজো ভুলতে পারেনি। কেননা তার কাছে শুনে ভুলতে পারিনি আমি এখনো। ঘরে এসেই সে বলেছিল, তোর বাসায় দেখি বিবাহিত স্ত্রী নিয়ে আসাও নিরাপদ না। নিচের এক লোক এমনভাবে তাকাচ্ছিল, আর এমনভাবে জিজ্ঞেস করছিলÑ যেন বাজারি মেয়েকে নিয়ে তার বাসায় আসছি আমি।

একা থাকলেও আমি যে আত্মীয়-স্বজন পরিত্যক্ত বা সমাজছাড়া মানুষ নই, সেটাও হাসমত মিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এ বাসায় ওঠার পরপরই। গ্রাম থেকে কখনো বা আমার ছোটভাই ঢাকায় এলেই বাসায় ওঠে। এছাড়া চাকরি সন্ধানী এক ভাগ্নেও আছে। সে তার মাকে নিয়েও এসেছিল। ভাই-বোনের মিলিত সংসার হয়ে উঠলে হাসেম মিয়াকে বোনের কথা বলেওছিলাম। কিন্তু তারপরেও লোকটা অবিশ্বাস করেছে কিনা কিংবা অন্য ভাড়াটিয়ারা কিছু ভেবেছে কিনা, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। আসলে এই বিল্ডিং-এর অন্য ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলি, সিঁড়িতে দেখা হলেও তারা রাস্তার মানুষ ছাড়া কিছু নয়। লোকমান মিয়ার মতো দুএকজন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসলেও সৌজন্য দেখিয়েই পাশ কাটি।

প্রথম দিকে বাড়ির যে কোনো সমস্যা, ভাড়াটিয়ার ভাড়া দিতে সময় নেয়া ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে হাসেম মিয়া আমাকে জানিয়ে মতামত নিতে আসত। কিন্তু আমি যে মূল মালিকের পরিচিত জনমাত্র, এ বাড়ির তুচ্ছ ভাড়াটিয়া হিসাবে হাসেম মিয়ার কাজে নাক গলানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এবং এ বাড়ির আসল মালিক হাসমত মিয়াই বটে, এটা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তারপরও সে আমাকে অন্য ভাড়াটিয়াদের মতো দেখে না। আমার সুবিধা-অসুবিধা বিষয়ে খোঁজখবর রাখাটাকে বড় দায়িত্ব হিসেবে জেনেছিল। যেহেতু একটি সংসার চালানোর মতো সবরকম যোগ্যতা রাখা সত্ত্বেও, আমি এখনো বিয়েথা করিনি। এর পেছনেও ট্রাজিক ঘটনা আবিষ্কারের আগ্রহ নিয়ে হাসমত একদিন আমার বাসায় ঢুকে খাতির জমানোর চেষ্টা করেছিল।

দারোয়ান মালেকে কয়, স্যার যে এতো বয়সেও এহনো বিয়াশাদি করে নাই, কোনো বেটি ছেকা দিছে মনে হয়।

আমি ছেকা খাওয়ার আনন্দে হেসে বলেছিলাম, হ্যাঁ ঠিকই বলেছে।

কিন্তু শুধু ছেকা খাওয়ার স্মৃতি ও বেদনা নিয়ে যে বাঁচা যায় না, সংসারের শ্রী ও শৃঙ্খলা রাখতে নারীর সেবাযতœ অপরিহার্য, এ বিষয়ে কিছুক্ষণ একঘেয়ে জ্ঞান বিতরণের পর হাসমত মিয়া আমার খাওয়া ও কিচেনের কারবার জানতে চেয়েছিল। বাইরে খাই এবং মাঝেমধ্যে নিজেও রাঁধি শুনে, অনিবার্য গ্যাস্ট্রিকের হাত থেকে মুক্তির উপায় বাতলে বলেছিল, এ বিল্ডিং-এর কয়েক ফ্ল্যাটে ঠিকা কাজের বুয়া কাজ করতে আসে। দেখি তাদের মধ্য থাইকা আপনার জন্য একজনরে ঠিক করে দিতে পারি কি না।

আমি বলেছিলাম, অবিয়া অল্পবয়সী কোনো মেয়ে হলে চলবে না।

হাসমত মিয়া হেসে বলেছিল, এই জ্ঞান কি আমার নাই বলেন। সেয়ানা কাজের মেয়ে ফেমিলি কোয়ার্টারেও কত প্রোবে ম তৈরি করে!

এভাবে জুম্মনের মাকে এ বাসায় আনার পটভূমি হাসমত মিয়াই তৈরি করেছিল। জুম্মনসহ প্রথম যেদিন সে আমার বাসায় আনে, আমি বছর চারেক বয়সের জুম্মনের দিকে মনোযোগী হয়েছিলাম বেশি। এইটুকু ছেলে বডিগার্ড হিসেবে মাকে কতটা রক্ষা করতে পারবে, তা বুঝে নেয়ার চেষ্টাতেই যেন। বড়জোর বছর পঁচিশ হবে বয়স জুম্মনের মায়ের। শ্যামলা গড়নের মেয়েরাও যে এত আকর্ষণীয় হয়, সেটা রবীন্দ্রসংগীত শুনে যেটুকু বুঝেছিলাম, জুম্মনের মাকে দেখে বুঝেছিলাম আরো বেশি। মনে মনে সেদিনই তার নাম দিয়েছিলাম শ্যামা। জুম্মনের মায়ের চাকরির সব শর্ত ও বেতন হাসমত মিয়াই নির্ধারণ করে দিয়েছিল। আমি সব মেনে নিয়ে আশ্বস্ত করেছিলামÑ কোনো সমস্যা হবে না।

প্রায় বছর খানেক একটানা কাজ করার পর জুম্মনের মা যে কাজ ছেড়ে দিয়েছে, হাসমত মিয়া জানত। নতুন এক কাজের মেয়েকেও ঠিক করে দিতে চেয়েছিল সে, আমি নিজের একাকিত্ব ও স্বাধীনতাকেই আগলে রাখার স্বার্থে না করে দিয়েছে। নিজে যেটুকু পারি রেঁধে খাই, অথবা বাইরের হোটেলে।

জুম্মনের মায় আপনার কাজ ছাড়ার পর এই বিল্ডিং-এ তো তাকে একদিনও দেখি নাই। অন্য এক কাজের মাতারি ঠিক কইরা দিতে চাইলাম, তাও রাজি হইলেন না। ওই মাইয়াটার লগে কি আপনার কোনো যোগাযোগ হইছিল?

হাসমত মিয়ার সঙ্গে দুচারদিন পর পরই দেখা হয়ে যায়, টুক টাক কথাও হয়Ñ কিন্তু একে কি যোগাযোগ বলা চলে? কিন্তু শ্যামার সঙ্গে আমার তিনমাসে একবারও দেখা হয়নি, কিন্তু মনে মনে কথা তো হয়েছে। হাসমত মিয়া কোন যোগাযোগের কথা জানতে চায়, বিরক্ত হয়ে বলিÑ কীসের যোগাযোগ?

ঠিক আছে, আমি না হয় একবার যোগাযোগ কইরা আসল ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি।

আপনারা যা খুশি করুন, কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আর কথা বলতে আসবেন না। যান, ঘরে আমার কাজ আছে।

একলা মানুষের ঘরে কী এমন জরুরি কাজ, বোঝার চেষ্টা না করেই হাসমত মিয়া বেরিয়ে যায়।




একাকিত্বের দুর্গে, অপিস কামরায় বা ভাড়া বাসার গর্তে আত্মগোপন করে যে আমি ওদের হাত থেকে মুক্তি পাবো না জানতাম। হাসমত মিয়াকে বের করে দেয়ার পর, বিচারক জনতার দলে যোগ দেবে অবশ্যই। কারণ জুম্মনের বাপ তার হুমকি কার্যকর করার জন্য হিংস্র হয়ে উঠেছে যে, গর্ভবর্তী স্ত্রীকে ফরিয়াদি সাজিয়ে বিচারক জনতাকে সংগঠিত করছে। কাগজে দেখছি, ইভটিজিং-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারীবাদীরা মিছিল করেছে। বখাটে ছেলেদের রুখতে সামাজিক আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। আমারটা তো শুধু ইভটিজিং নয়, অবৈধ গর্ভ সৃষ্টির ব্যাপার। অসহায় দরিদ্র গৃহবধূকে নিজগৃহে যে ধর্ষণ করেছি, তার সাক্ষী হয়তো শিশু জুম্মনই দেবে। শিশুরা মিথ্যে বলে কখনো? তাছাড়া দশ হাজার টাকা দিতে চাওয়ার বিষয়টি তো নিজেও কবুল করেছি। সাক্ষী আছে লোকমান সাহেব। সব জানলে-শুনলে আমার মতো সমাজবিরোধীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার মতো বিবেকী মানুষের আকাল হবে না দেশে।

জুম্মনের বাপ হয়তো এরইমধ্যে স্থানীয় মসজিদের ইমাম, ওয়ার্ড কমিশনার, মহল্লার কিছু পরোপকারী মুসল্লি, যুবনেতাকে বলেছে। কাজেই যে কোনো ছুটির দিন আমার বাসার সামনে শখানেক মানুষের ভিড় জমা বিচিত্র কিছু নয়। এত লোক সিঁড়ি ভেঙে ওপরে আমার ফ্ল্যাট পর্যন্ত আসবে না। হাসমত মিয়া ও জুম্মনের বাপ কয়েকজন যুবনেতাকে নিয়ে আমার ঘরে এসে বলবে, আপনাকে নিচে নামতে হবে, সবাই অপেক্ষা করছে। আমি প্রতিরোধ বা পলায়ন করার জন্য দরজা চেপে দেয়ার আগেই হয়তো টেনেহিঁচড়ে নিচে নামাবে ওরা। কী করার আছে আমার? আমি শয়নে-স্বপনে ঘরের বাইরে শুধু বিচারক জনতাকে দেখি। এই ভিড়কে মোকাবিলা করার উপায় খুঁজতেই যেন ঘুরেফিরে জুম্মনের মায়ের কথা মনে পড়ে।

সব মিলিয়ে বছর খানেক আমার বাসায় কাজ করেছে মেয়েটি। রোজ সকালে এসে কলিংবেল বাজিয়ে আমার ঘুম ভাঙাত। দরজা খুলে প্রথমে আমি জুম্মনের দিকে তাকাতাম, কথাও বলতাম টুকটাক তার সঙ্গে। কিন্তু অন্তরে গাঁথা হয়েছে শ্যামার মুখ। তার বাজানো কলিংবেলের আওয়াজটা এমন স্বতন্ত্র যে, তেমন আর কেউ বাজাতে পারে না। ঘুম ভাঙতেই মনে ভাসত শ্যামার মুখ, দরজা খুলে তাকে দেখতে পাওয়ার আগ্রহের মধ্যে জুম্মন ছিল না বলেই বোধহয় ওর দিকে তাকাতাম বেশি। বাচ্চা হলেও সে ছিল শ্যামার দেহরক্ষী। শুরু থেকেই জুম্মন আমার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছিল। আমি যখন বাথরুমে ও তার মা যখন রান্নাঘরে ব্যস্ত, আমার শোবার ঘরে উঁকি দিতে শুরু করেছিল জুম্মন। কথা বলত না, কিন্তু জুলজুল করে তাকিয়ে থাকত। তার সাহস ও কৌতূহল এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠছিল যে, আমার অনুপস্থিতে কম্পিউটার চালানোর চেষ্টা ও মোবাইলফোন হাতে নিয়ে টেপাটেপি করেছে। বাথরুমে উঁকি দিয়ে আমার দাড়িকাটার দৃশ্য পর্যন্ত দেখেছিল। ডাকু-স্বভাবের ঐ ছেলেকে দেখে তার বদমাশ পিতা সম্পর্কে কোনো ধারণা করার প্রয়োজন হয়নি সেদিন, তবে ঘরের এটাসেটা জিনিস খোয়া যাওয়ার ভয় জেগেছিল। ঘরে ঢুকে আমার এটাসেটা জিনিসে চোখ দেয়ার অপরাধে ছেলেকে মেরেও শাসন করেছে শ্যামা। আমাকে যাতে কোনোভাবেই বিরক্ত করা না হয়, সে জন্য রান্না ঘরের সামনে বই হাতে জুম্মনকে বসিয়ে রাখত। কাজের সময়েও জুম্মনকে চোখে চোখে রাখত। কাজের মেয়ে হলেও শ্যামা যে কিছু লেখাপড়াও জানে, সেটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য নাকি সন্তানকে ঘিরে তার স্বপ্ন ও দায়িত্বশীলতা বোঝাতে কাজের ফাঁক ফাঁকে মাস্টারি করত জানি না। তবে তার মাতৃরূপ নয়, শ্যামা পরিচয়টাকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলাম আমি। এ নামে ডাকার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন, তোমাকে কী নামে ডাকা যায় বলো তো?

আমাকে সবাই জুম্মনের মা কয়, আপনিও তাই কইয়েন খালু।

আরে, আমারে খালু বলছো কেন? আমাকে কি এত বুড়া দেখায়, এখনো তো বিয়াই করিনি।

কিন্তু আমার কৌমার্য বা বয়স নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না শ্যামার। অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল, কী ডাকব তাইলে?

স্যার না ডাকতে পারো, ভাইটাই বলতে পারো।

ঠি^ক আছে ভাইজান, আপনি ঘরে যান, আমি চা দিয়া আসতেছি।

কাজ ছাড়া যে আমার কোনো কিছুতেই শ্যামার কোনো আগ্রহ নেই, সেটা বোঝাতেই তৎপর ছিল সে। আমিও আর কৌতূহল দেখাইনি। জুম্মন ও মাতৃরূপ ছাড়া শ্যামার অন্যতর রূপ আবিষ্কারের চেষ্টা করিনি। আমার বাসায় এসেও ঝটপট কাজ শেষ করতে চাওয়া এবং ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার মানসিকতা দেখে শ্যামাকে স্বার্থপর টাইপের মেয়ে মনে হয়েছে। প্রথম দিকে আমার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বেশি রান্না করত সে। ভেবেছিলাম, উদ্বৃত্ত খাবারে ছেলে ও মায়ের ভাগ বসানোর মতলব আছে। কিন্তু উদ্বৃত্ত খাবার ফ্রিজে রেখেও যখন উদ্বৃত্ত থেকে যেত, অপরাধী কণ্ঠে বলেছিল শ্যামা, আমার রান্না কি ভাল হয় না, খান না যে ভাইজান। সব ফ্রিজে রাখি, তাও খান না।

ফ্রিজে রাখবে না, খাবার বাঁচলে জুম্মন ও তুমি খাবে, অথবা বাসায় নিয়ে যাবে।

কিন্তু মেয়েটি যথেষ্ট হিসেবী, আমার চাহিদা বোঝার পর নিজের স্বার্থের কথা ভেবে অপচয় করেনি। আর তার মাতৃরূপ শুধু জুম্মনের জন্য নয়, আমার জন্য রান্না ও ঘরসংসার গুছিয়ে রাখার মধ্যেও যেন অনেকটা ফুটে উঠত। পয়সা দিয়ে কেনা এই প্রাপ্তিটুকুর বাইরে জুম্মনের মায়ের মধ্যে আমি শ্যামাকে খুঁজতে চাইনি আর। সকালে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নাস্তা ও রান্নার কাজ শেষ করে, আমার অফিসে যাওয়ার আগেই সে চলে যেত। অন্য এক বাসার কাজে। রাতের রান্নার জন্য রাত ৮টার পরে আসত একবার। ঘণ্টা খানেকের বেশি থাকার প্রয়োজন হতো না। অর্থের বিনিময়ে জুম্মনের মায়ের এইটুকু উপস্থিতি ও সেবা-যতœ আমার একলা চলার অভ্যাস ও শৃঙ্খলাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি।

মাস দুয়েক পর জুম্মনের মা-ই প্রথম আমার একাকিত্বের গর্তে ঢোকার আগ্রহ দেখিয়েছিল। সেই সময়ে তার বডিগার্ড পড়তে পড়তে মাদুরের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ভাইজান, বিয়াশাদি করে ভাবীরে সংসারে কবে আনবেন? সবকিছু থাকতেও একলা থাকেন!

স্বজনশুভার্থীরা এরকম প্রশ্ন করে করে এতটাই ক্লান্ত যে, কেউ এ নিয়ে ভাবেও না বোধহয়। জুম্মনের মায়ের ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে জবাব দেই, আমারে যে কোনো মেয়ে পছন্দ করে না। আমারও ভদ্র ফেমিলির শিক্ষিত কোনো মেয়েকে ভাল লাগে না। কাজেই একলা না থেকে দোকলা পাই কোথায় বলো।

কী যে কন ভাইজান! কী নাই আপনার, চাকরি-ফ্ল্যাট সবকিছু থাকতেও আপনি এখনো বিবাহ করার কথা ভাবেন না। আর আমার স্বামী আমারে ফেলায় থুইয়া আরেকটা বিয়া করছে, বোঝেন কীরকম পুরুষ মানুষ!

তোমার সতীনের সংসার?

সতীনের সংসার আমি করুম না। আমার বইনের লগে আলাদা বাসা নিমু, জুম্মন আর একটু বড় হইলে ওই বেটারে নিজেই তালাক দিমু আমি।

আমি জুম্মনের মায়ের স্বামী-সংসার নিয়ে আর কৌতূহল দেখাইনি। মনে সন্দেহ জেগেছিল, জুম্মনের মা কি জুম্মনসহ পাকাপোক্তভাবে আমার সংসারে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে? এতটা দুঃসাহস তার হবে না হয়তো। কোনো ভদ্রলোক মনিব তার গৃহপরিচারিকাকে, তা সে যতই গুণবতী বা রূপবতী হোক, স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে এমন নজির নেই। কিন্তু আমি যদি জুম্মনসহ তার মাকে মর্যাদা দিয়ে এই ফ্ল্যাটে স্থায়ী নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করি? এই ভাবনায় আমার কিছু রোমাঞ্চ হয়েছিল বটে। এটা করতে পারলে আমার সমাজবিরোধী স্বভাবটাও ভালভাবে প্রকাশ পেত। ভিতরের এসব অলস ভাবনা-চিন্তা থেকে জুম্মনের মাকে ঘিরে যেটুকু কামনা-বাসনা জাগতে শুরু করেছিল, তার গভীরতা ও পরিণতি মাপতে শুরু করেছিলাম মেয়েটার শরীরের দিকে তাকিয়ে। ছেলেকে কিচেনের সামনে বসিয়ে যখন সে আমার বেডরুম ঝাড়পোছ করতে আসে, আমি দরজা চাপিয়ে দিলে ঐটুকু প্রহরী মাকে রক্ষার চেষ্টা দূরে থাক, প্রতিবাদও করতে পারবে না। জুম্মনের মা কি এরকম জবরদস্তি আশা করছে? এটুকু বোঝার জন্য মেয়েটার সঙ্গে যেটুকু সম্পর্ক-সেতু দরকার, তা রচনার জন্য দৃষ্টির খুঁটি কিংবা কথার ইট-সিমেন্ট ব্যবহার করার মতো রুচি হয় না। সাময়িক বা স্থায়ীভাবে আমি যদি তাকে একান্ত করে পেতে চাই, তবে আমার এ বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে সাড়া দেয়ার ক্ষমতা তার দেহ ও মনে আছে কতটুকু? কথার মাধ্যমে না হলেও এ প্রশ্নের সঠিক জবাব খোঁজার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আমার মধ্যে। ফলে সুযোগ পেলেই তার শরীরে সার্চলাইটের মতো ঘুরত। একদিন ঘর ঝাট দেয়ার সময় তার পশ্চাতদেশ খুঁটিয়ে দেখেছি, আর একদিন কিচেনে বেগুন কাটার সময় তার ঠোঁটমুখের রঙ-বদল খুঁজেছি এবং আর একদিন আমার জন্য প্রতিরোধক আর জুম্মনের জন্য আইসক্রিম কিনে এনে, আইসক্রিমসহ জুম্মনকে রান্নাঘরে বসিয়ে রেখে, শ্যামা আমার ঘর ঝাঁট দিতে এলে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে সরাসরি হুকুম দেওয়ার কথা ভেবেছি, Ñ যাও জলদি বাথরুমে ঢুকে সাফসুতরা হয়ে পারফিউম দিয়ে আস।

শ্যামার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই, নিজের কৌতূহল কিংবা বিকৃত পিপাসা চরিতার্থ করার জন্য একটি দিন আমি খুব উদার হয়ে যাই। শ্যামাকে এক হাজার টাকা এগিয়ে দিয়ে বলি, টাকাটা রাখো। তোমার ভালো শাড়িটাড়ি কিনবে, জুম্মনের জামাও কিনে দিতে পারো।

মাসের মাঝামাঝি প্রাপ্য বেতনের চেয়েও বেশি টাকা পাওয়ার এই সুযোগ দেখে চমকে উঠেছিল শ্যামা। তীক্ষè দৃষ্টিতে আমার দিকে নিবদ্ধ করতেই কি ভেতরের মতলবটা ধরে ফেলেছিল সে? জানতে চেয়েছিল, আমারে এত টাকা দিতে চান কেন ভাইজান?

আমি সরাসরি বলেছিলাম, একদিন ছেলেকে তোমার বোনের কাছে রেখে বেশি সময় নিয়ে এসো, বুঝিয়ে বলব। ঠিক আছে?

আমার এই সরল স্বীকারোক্তিতে হাজার টাকার গোপন মতলব বুঝে লজ্জা নাকি ঘৃণায় মাথা নিচু করে ছিল সে? তবে নির্মম কণ্ঠে প্রত্যাখ্যান করেছে, আপনি এইরকম কথা বললে আমি বাসার কাজ ছেড়ে দেব ভাইজান। স্বামী লম্পট বইলা খানকি হইয়া তার ওপর শোধ নিতে পারব না আমি।

জুম্মনের মায়ের প্রত্যাখানে আমি খুব অপমানিত বোধ করেছিলাম। নিজের না প্রেমিক না বিপ্লবী স্বভাব উপলব্ধি করে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। টাকা লেনদেনের সম্পর্কটা সফল হলেও আমার এ একাকীত্ব যে কাটবে নাÑ এটা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজেছি।

আমার টাকা ও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরও জুম্মনের মা যথারীতি তার দেহরক্ষী সন্তানকে নিয়ে কাজে এসেছে। আমিও যথারীতি দরজা খুলে দিয়েছি। কিন্তু জুম্মন ও তার দিকে ফিরেও তাকাইনি, বাড়তি কথা বলার চেষ্টা করিনি একটুও। মনিব ও গৃহপরিচারিকার মধ্যে যেটুকু সম্পর্ক এবং যে দুর্লঙ্ঘ ব্যবধান, সেটাকেই সত্য ভেবে নিজের একাকিত্ব আগলে রাখতে চেয়েছি। জুম্মনকে রেখে শ্যামা একলা এলেও যে তাকে আমি ধর্ষণ করার মতো জন্তু-জানোয়ার নই, নির্বিকার দূরত্ব রচনা করে হয়তো এই ধারণাও দিতে চেয়েছি মেয়েটাকে। কিন্তু সে আমার মানবতাবোধে কতটা ভরসা পেয়েছে জানি না। বাড়তি আগ্রহ বা ঘনিষ্ঠতা দেখিয়ে আমার একাকিত্বের গর্তে নাক গলানোর চেষ্টা করেনি আর।




প্রকৃতির সঙ্গে কতটা একাত্ম হলে হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হাঁটার অনুভূতি সত্য হয়ে ওঠে আমি জানি না। তবে ঢাকার জনারণ্যে জনতার সঙ্গে সম্পর্কের সেতু কিংবা বিন্দুমাত্র একাত্মতা নেই বলেই কি মনে হয়, আমি যেন নিজস্ব গর্তে হাজার বছর ধরে আটকে আছি একা? রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে অচল বাসে এক ঘণ্টা আটক থাকলেও মনে হয় অনন্তকাল আটকে আছি। সচল হয়ে ওঠার জন্য চারপাশে মানুষের ছটফটানি টের পাই, কিন্তু মুক্তিকামী অচল ভিড়ের সঙ্গেও কোনো একাত্মতা বোধ জাগে না আমার। বরং মনে হয় শত্র, এই ভিড়, চারপাশের গিজগিজে মানুষের সমাজ আমার চলার পথে ব্যারিকেড বিশেষ।

কখনো-বা টের পাই, আমাকে একলা ও অচল রেখে. ঠেলাগুঁতো মেরে যে যার মতো এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সবাই। আমি ঘরে, অফিসে কিংবা রাস্তায় জ্যামে আটক বাসের ভিতরে মড়ার মতো নিশ্চল চোখ বুজে বসে থাকি। উদ্বেগ-অস্থিরতা নেই, আবার ছুটে চলার আনন্দ-উত্তেজনাও নেই। একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কখনো-বা স্মৃতি-স্বপ্ন জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি নির্জন একটি নদীতীরে দাঁড়িয়ে থাকি একা। ধানক্ষেতের আলপথ ধরে একলা হাঁটি। ফসলের সবুজ সমুদ্রে বাতাসের ঢেউ দেখি। রাতের আকাশের নক্ষত্রের মালা গলায় পরে সপ্ত আসমানে উড়ে উড়ে বেড়াই একা। খুব চেনা নারীর সান্নিধ্যে থেকে স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজি কখনো-বা। এরকম জীবন স্মৃতিতে আছে, নাকি কল্পনায় ধরা দেয়Ñ মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি না। চোখ বুজে সেই অধরা জীবনের স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করি, তবু চারপারশের চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সেতু বানাবার উৎসাহ পাই না।

জুম্মনের মায়ের প্রত্যাখ্যান, অপমান ও একাকিত্ব হজম করে তার সঙ্গে সম্পর্কটা বজায় রাখতে চেয়েছি। নিরাপদ দূরত্বটা তাই ক্রমেই বাড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন কাজ ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেয় সে, আপনার বাসায় বোধহয় আর কাজ করতে পারব না ভাইজান। বহুত সমস্যার মধ্যে আছি আমি। জুম্মনরে স্কুলে ভর্তি করামু, হ্যার বাপে টাকা না পাইলে আমারে তালাকও দিব না। এই মাসে হাজার দশেক টাকা যোগাড় করতে না পারলে ঢাকাতেও থাকতে পারুম না। এই জন্য বাড়িতে মায়ের কাছে যামু।

আমি যদি তোমাকে দশ হাজার টাকা দিই, সমস্যা মিটবে তোমার?

আপনি আমারে এত টাকা দেবেন কেন?

বিনিময়ে কিছু দিতে হবে না তোমাকে। এমনি নিতে না চাও, পারলে বেতন থেকেই মাসে মাসে কিছু শোধ করে দিও।

কয়েক মুহূর্ত ভেবেচিন্তে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠাণ্ডা গলায় প্রত্যাখ্যান করেছে সে, না ভাইজান, আপনি নতুন কাজের বুয়া পাইবেন, আমি আগামী মাস থেকে আসতে পারব না।

মাস শেষে বেতন নিয়ে জুম্মনের মা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময়, আমি অন্য কাজের মেয়ে ঠিক করেছি কিনা জানতে চাইলে জবাব দিয়েছি, আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। যাও তুমি।

এই পর্যন্তই সম্পর্ক তার সঙ্গে। এরপর চার মাস কেটে যাচ্ছে। এর মধ্যে জুম্মনের মা কীভাবে ও কার বীর্যধারণ করে গর্ভবর্তী হয়েছে, নাকি হয় নাই, আমি কিছুই জানি না। সত্য জানার জন্য জুম্মনের বাপ-মা কিংবা আরো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করারও ইচ্ছে হয় না আমার।

মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী কী নেলসন ম্যান্ডেলার মতো জননেতাদের কথা। দেশ ও জনগণের সঙ্গে একাত্মতা বোধ এতটাই শক্তপোক্ত যে জেলের নির্জন সেলে আটক থেকেও একা হন না তারা। জেলেই থাকুন, আর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পারিবারিক বন্ধনে, চেতনায় সারাক্ষণ উপস্থিত থাকে কোটি কোটি মানুষ। মানুষের জন্য ভালবাসা কতটা খাঁটি ও গভীর হলে একজন দেশপ্রেমিক কিংবা মানবতাবাদী হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করার প্রেরণা পান, আমি ঠিক জানি না। তবে স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সচল জনস্রোতে কিংবা অচল ভিড়ের অংশ হয়েও জনতার সঙ্গে মিতালি নেই আমার। বরং ভিড়ভাট্টা ও চারপাশের মানুষজনকে মনে হয় শত্র। এরকম গণবিরোধী বলেই বোধহয় নিজস্ব গৃহকোণে একা নিরাপদ বোধ করি। কিন্তু জুম্মনের বাপের হুমকি আমরা একলা ঘরের নিরাপত্তা হরণ করেছে যেন। বিচারক জনতাকে মোকাবিলার জন্য আমিও নেতাদের মতো সাহসী ও জনপ্রেমিক হয়ে ওঠার কথা ভাবি।

বিচারক ভিড় জুম্মনের মায়ের গর্ভের দায় চাপানোর জন্য সত্যই যদি আমার ঘরের দরজায় আসে আবার, আমি কি সাহসী নেতার মতো গর্জে উঠতে পারি নাÑ ঠিক আছে ভাইসব, জুম্মনের মা যদি নিজমুখে বলে, আমি তার গর্ভের সন্তানের পিতা, তা হলে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সে আমার স্ত্রী হিসেবে সংসারে উঠুক, আমি গর্ভসহ তার, এমনকি জুম্মনেরও সকল দায়দায়িত্ব নেব, কিন্তু জুম্মনের বাপকে দশ হাজার কেন, একটা টাকাও দেব না আমি।

এরকম ঘটলে, এই ঘটনার খবর হয়তো সংবাদপত্রেও আমার ছবিসহ ছাপা হবে। সাহসী নায়ক হিসেবে আমার প্রচার হোক বা নাই হোক, বিচারক ভিড়কে মোকাবিলার জন্য একটা মোক্ষম অস্ত্র হাতে পেয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক অনেকটাই কেটে যায় আমার।




রাতে যেদিন জুম্মনের মায়ের গর্ভ নিয়ে কী এক দুর্বোধ্য স্বপ্ন দেখি, সেইদিন সকালে যথারীতি জুম্মনের মায়ের কলিংবেল শুনে ঘুম ভাঙে আমার। দরজা খুলে জুম্মন ছাড়াই তাকে একা সামনে দেখতে পাই। ভয়ে-উত্তেজনায় বুক ধকধক করে। জনগণকে পথ দেখানো নেতাদের বুক এভাবে কাঁপে কখনো? চকিতে জুম্মনের মায়ের পেটের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারি, তার গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা মিথ্যে নয়। জুম্মনের মায়ের পিছু পিছু বিচাকর ভিড়ও এসেছে কিনা দেখার জন্য, সিঁড়ির দিকে তাকাই।

কী ব্যাপার তুমি! সঙ্গে আর কে এসেছে?

আমি একাই এসেছি, আপনারে একটা কথা জিগাইতে।

আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে জুম্মনের মা ভেতরে ঢোকে। আমি দরজা খোলা রেখেই মুখোমুখি দাঁড়াই।

জুম্মনের বাপ বলে সেদিন মানুষ নিয়া আপনার কাছে আসছিল। দশ হাজার টাকা চাইছিল?

হ্যাঁ, অনেক বাজে কথা বলেছে। টাকাটার জন্য তুমিই কি স্বামীকে পাঠিয়েছিলে?

আমি পাঠামু কেন? আপনি যে কত ভাল মানুষ সেইটার প্রমাণ দিতেই আমি টাকার গল্পটা তার কাছে করছিলাম। কিন্তু শয়তানটা আপনার বাড়িত আইয়া মিথ্যা বদনামী দিয়া টাকা চাইল, আর আপনি বলে ঘরের দরজা বন্ধ কইরা পলায় রইছিলেন! আমি একলা মেয়েমানুষ, জুম্মনের লাইগা কিছু করতে পারি না। কিন্তু কীরকম পুরুষ মানুষ আপনি!

আমি দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে, তুমি চাইলে সে টাকা এখনো নিতে পারো।

আমি আপনার টাকা নিতে আসি নাই।

তা হলে কেন এসেছ জুম্মনের মা? আমার অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসার জবাব দিতেই যেন সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে? আমি কেমন পুরুষ মানুষÑ সেইটা বোঝার শেষ চেষ্টাতেই কি? কী খুঁজে পায় সে কে জানে, তার চোখে টলমল অশ্র গড়ায়। আর একটিও কথা না বলে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি বিচারক জনতাকে মোকাবিলা করার জন্য কতো কী ভেবেছি, কিন্তু আমার শ্যামা, গর্ভবতী জুম্মনের মাকে ফেরানোর মতো কোনো কথা খুঁজে পাই না।
----
সূত্র: নতুন ধারা: মে ২০১০

No comments: